মাথায় কোন নারী চেপে বসলে বড় বড় যুদ্ধবাজও হাতিয়ার উঠানোর যোগ্য থাকে না। ইউগেলিস বললো, কোন নারী যদি কোন কাপুরুষের পিঠে হাত রেখে তাকে বলে, আমি তোমার আত্মমর্যাদাবোধের প্রতীক, তাহলে সে কাপুরুষও অতি কঠিন যুদ্ধবাজকে হাঁটু মুড়ে বসতে বাধ্য করে। উন্দলুসের বাদশাহকেও আমরা এভাবে বেকার করে ছাড়বো।
ইউগেলিস তার পকেট থেকে ছোট একটি বাক্স বের করলো। সেটা খুলে সুলতানার সামনে রেখে বললো,
সুলতানা! এই সামান্য নজরানা শাহে ফ্রান্স লুই-এর পক্ষ থেকে। তবে তোমার আসল এনআম তোমার অপেক্ষায় আছে।
আমাকে আর কি করতে হবে? সুলতানা জিজ্ঞেস করলো।
এটাই যা তুমি করে যাচ্ছে। আমি তোমাকে সময়মতো সবকিছু বলে যাবো।
যে তিন পরিচারিকার জন্য আবদুর রহমান পাগলপারা ছিলেন ওদেরকে আমি হাত করে নিয়েছি। মহলে এখন আমার সঙ্গে কারো কোন শত্রুতা নেই। পুরুষদের মধ্য একমাত্র গায়ক যারিয়াব আছে যার ওপর শাহে উন্দলুস বলতে গেলে আশেক। দরবারে যারিয়াবের দারুন প্রভাব। বলতে গেলে তারই হুকুম চলে দরবারে। সে যা ইচ্ছা তা করতেও পারে এবং করাতেও পারে।…..
যারিয়াবের মধ্যে এমন এক অপার্থিব শক্তি আছে যে, সে যা কাউকে দিয়ে মানাতে চায় মানিয়ে নেয় সেটা। শাহে উন্দলুস যেন তার সামনে বাচ্চা বনে যান। আমাকে সে একটু ভিন্ন চোখে দেখে। আমি সে দৃষ্টি পড়তে পারি। আমার পুরোপুরি বিশ্বাস আছে, অন্যকে যে জাদুতে বশ করে সেও আমার জাদুর শিকার হয়ে যাবে।
একে আমাদের হাত করা জরুরি। ইউগেলিস বললো, আর আরেকবার শুনে নাও সুলতানা! আবদুর রহমানকে মেরে ফেলা যাবে না। তার থেকে আমাদের ফায়দা উঠাতে হবে। তাকে ভোগবিলাসে মত্ত রাখো, বাকি কাজ আমরা করবো।
ইউগেলিস! সুলতানা একটু ভারি গলায় বললো, আমার ব্যাপারে তোমাকে একটা কথা আমি বলে দিচ্ছি। আমি কখনো কারো হাতের খেলনা হইনি। অন্যকে আমি আমার খেলনা বানিয়ে অভ্যস্ত। তুমি আমাকে এখনো বলোনি তোমাদের আসল পরিকল্পনা কী? তোমাদের চক্রান্তটা কি যেটার জন্য তোমরা আমাকে দিয়ে শিকড় উপড়ানোর কাজ করিয়ে যাচ্ছো।…..
আমার প্রতি কি তোমাদের কারো বিশ্বাস নেই? আমাকে দিয়ে তোমাদের চক্রান্ত সফল করে পরে আমাকেই ছুঁড়ে ফেলবেন এর কি নিশ্চয়তা আছে? আমাকে এসব মূল্যবান মণিমুক্তা দিয়ে খরিদ করার চেষ্টা করো না ইউগেলিস!
আমাকে বলা হয়েছিলো তুমি অনেক বুদ্ধিমান এবং সব ধরনের ইংগিত বুঝতে পারো। ইউগেলিস বললো, আমার তো মনে হয় তোমাকে বেছে নিয়ে আমি কোন ভুল করিনি। এখনো কি তুমি বুঝতে পারোনি আমাদের পরিকল্পনা ও চক্রান্তটা কী?……..
তোমার হয়তো মনে আছে, প্রথম সাক্ষাতে যখন তুমি আমার ছদ্মবেশ ধরে ফেলেছিলে তখন আমি আমার পরিচয় দিয়ে তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার ধর্ম কি?….আর ধর্মের ব্যাপারে তোমার চিন্তাভাবনা কি?
তুমি বলেছিলে ধর্মের ব্যাপারে তোমার কোন আগ্রহ নেই। তোমার ধর্ম শুধু সম্রাজ্ঞী হওয়ার এক স্বপ্ন। আমি তোমাকে বলেছিলাম, তোমাকে আমরা সম্রাজ্ঞী বানিয়ে দেবো। এখন কিছু দিন শাহ আবদুর রহমানের সম্রাজ্ঞী হয়ে থাকো। উন্দলুসের মুসলিম শাসনের যখন পতন ঘটবে তখন এক অঙ্গরাজ্যের সম্রাজ্ঞী হবে তুমি। আর সেটা তোমাকে দেবেন শাহে ফ্রান্স।………
আমাদের মূল পরিকল্পনা হলো, এই দেশে বিদ্রোহ সৃষ্টি করা। আমরা অতি গোপনে এক আন্দোলন শুরু করেছি। তুমি হয়তো জানো, যেখানে বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয় সেখানে বাদশাহর সৈন্যরা ব্যাপক হত্যাকৰ্ম চালায়। বাদশাহ যদি যারিয়াবের মতো গায়ক ও তোমার মতো জাদু জাগানো সুন্দরীর মধ্যে অচেতন হয়ে পড়ে থাকে তাহলে তার সব ব্যবস্থাপনা দুর্বল ও বিশৃংখল হয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর মধ্যেও ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়।…..
তোমার কাজ এটাই হবে, শাহে উন্দলুসকে নিজের রূপ যৌবন দিয়ে বেঁধে রাখা। যখন তাকে জানানো হবে তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে তখনো যেন তিনি বাস্তব দুনিয়ায় ফিরে না আসেন।…..আমি কি বলছি তুমি বুঝতে পেরেছো সুলতানা?…..
আমরা আবদুর রহমানকে বাঁচিয়ে রাখবো ঠিক, কিন্তু তার ভেতরের অকুতোভয় লড়াকু যোদ্ধা ও দূরদর্শী নেতৃত্বদানের ক্ষমতাকে গলা টিপে মেরে ফেলবো। এটা সহজ কাজ নয়। এজন্য তোমার পুরস্কারও নির্ধারণ করা হয়েছে এত বেশি।–একটি রাজত্ব, যার রানী হবে তুমি।
***
ইউগেলিস কোন কাল্পনিক বা ঔপন্যাসিক চরিত্র নয়। ইতিহাসের অতি জলজ্যান্ত এক চরিত্র ইউগেলিস। স্পেন থেকে মুসলিম শাসন গুটিয়ে যাওয়ার এবং মুসলমানদের পতনের প্রথম সারির ভিলেন এই ইউগেলিস। কুদরত তাকে অসাধারণ মেধার অধিকারী করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের দারুন পন্ডিত ছিলো সে। আরবী ভাষায়ও সে দক্ষতা অর্জন করে। পবিত্র কুরআনের গভীর জ্ঞানও সে আয়ত্ব করতে সক্ষম হয়।
উন্দলুসের পাম্পুলুনা নামক স্থানে খ্রিষ্টীয় উপসনালয়ের এক পোড়াবাড়ি আছে। সেখান থেকে ইউগেলিস একটি বই সংগ্রহ করে। এর মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জীবনাদর্শ নিয়ে অনেক অর্থহীন ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা লেখা আছে। বইটি হাতে লেখা। এর মধ্যে বিভিন্ন ঘটনার ভিত্তিহীন ও বানোয়াট উদ্ধৃতিও দেয়া আছে। যে কারণে ভিত্তিহীন একটি বই মুখদের কাছে নির্ভরযোগ মনে হওয়ার সবরকম উপাদান তাতে ছিলো।