বর্তমান আমীরে উন্দলুসের বাপ আল হাকাম আমাকে দেখে তো তাঁর ব্যক্তিগত আস্তাবল থেকে আমার বাপকে একটি আরবী ঘোড়া যিনসহ এবং একটি তলোয়ারও দেন। যার বাটে ছিলো দুটি জ্বলজ্বলে হিরা। তারপর আমার বাবাকে বিশেষ মর্যাদাও দান করেন। আর আমাকে তার জন্য নিশ্চিত করেন।….
আমিও মনে করতাম, রূপ যৌবনের কোন ক্ষয় নেই। আমার মাথার প্রথম পাকা চুলটি আমাকে ক্ষ্যাপিয়ে দিয়ে ছিলো। আমি চুলটি আক্রোশে ছুঁড়ে মারি। কিন্তু কিছু দিন পরই মানতে বাধ্য হই, যে চুল আমীরে উন্দলুসের শিকলের মতো পেচিয়ে ধরেছিলো সে চুল সাদা হয়ে এখন অর্থহীন হয়ে যাবে। এটা মেনে নিই যে, আমার রূপের চমক আর কোন দিন কাউকে আকর্ষিত করবে না।….
মালিকায়ে তরূব! তখন থেকে আমি মহলের বোঝা হয়ে গেলাম। হেরেমের আস্তকুড়ে আমাকে নিক্ষেপ করে। সে সব মেয়ের দিনও দেখেছি যাদের চারপাশে সখিরা ঘুরেছে। আমীর পুত্ররা তাদের পানি গ্রহণের জন্য তাদের কাছে ছুটে এসেছে। তাদের ইশারায় পুরো মহল নাচতো। সেই তারাও অচল মুদ্রা হয়ে গেছে। আমার বয়স পোত্তর হয়ে গেছে। আমি হেরমের প্রতিটি মেয়ে, নর্তকী ও গায়িকাদের জন্য এক শিক্ষনীয় উদাহরণ।
মালিকা! আপনি এই বাস্তবতাকে গ্রহণ করে নিন যে, আপনার সময় শেষ হয়ে গেছে। আমীরে উন্দলুস আব্দুর রহমানও প্রায় বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছেন। এখন কোন রূপবতী যুবতী মেয়েই তার মধ্যে সেই আবেগ আর যৌবনের আমেজ জাগিয়ে তুলতে পারবে না।
সুলতানা তার অতীতে হারিয়ে গেলো। উদাম চোখে ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর নিঃশব্দে উঠে কামরায় পায়চারী করতে লাগলো।
মালিকায়ে তরূব! খাদেমা বললো, আপনি এত বিচলিত হয়ে পড়েছেন কেন? আপনি সৌভাগ্যবতী যে, আমীরে উন্দলুস আপনাকে এখনো আপনার সেই অবস্থান থেকে বঞ্চিত করেননি। আমি তো আপনার প্রতি সহানুভূতিশীল। আপনি সবসময় আপনার মনের কথা আমাকে বলেছেন। এজন্য আমি আপনাকে বাস্তব কথাটা বলে দিয়েছি। আপনাকে আমি পেরেশান করতে চাইনি।
আমি জানি! সুলতানা বললো, তোমার আন্তরিকতা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমীরে উন্দলুস আমাকে আমার অবস্থান থেকে ছুঁড়ে মারেননি। তবে বছর খানেক হয়ে গেলো তিনি আমাকে তার কাছে যেতে আর আগের মতো ডাকাডাকি করেন না। আমি নিজ থেকে কখনো উনার কাছে গেলে তিনি কোন ব্যস্ততার কথা তুলে আমাকে চলে আসতে বলেছেন। এখন আমার নিঃসঙ্গ জীবন কাটছে। যারিয়াব না থাকলে হয়তো আমি বেঁচে থাকতে পারতাম না।
আপনার ছেলে সদ্য যুবক। তাকে খোদা দীর্ঘজীবন দান করুন। খাদেমা বললো, ওর জন্যই এখন আপনার বাকি জীবনটুকু বিলিয়ে দিন। তাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার হিসাবে গড়ে তুলুন। আমীরে উন্দলুস বৃদ্ধ বয়সেও প্রতিটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছেন। যে কোন সময় তাঁর মৃত্যু হতে পারে।
অবশ্যই, অবশ্যই। আমি তো গত বিশ বছর ধরে এ চেষ্টাই করে যাচ্ছি। কিন্তু আমীরে উন্দলুস এ ব্যাপারে কখনো কোন কথা বলেননি। এর অবশ্য কারণও আছে। আমার ছেলে স্বভাব-চরিত্রে বিগড়ে গেছে। আমি তো ওকে শাহজাদা বানিয়েছি। কিন্তু ও আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ওকে আমি শাহসাওয়ারী ও তীরান্দাজী শিখতে সেরা উস্তাদের কাছে পাঠিয়েছি। কিন্তু সে ফাঁকি দিয়ে কোথাও চলে গেছে। টাকা-পয়সা উড়ানো ছাড়া আর কিছুই শিখেনি সে।
যে টাকা-পয়সা উড়াতে জানে না সে আবার কিসের শাহজাদা! আমীরে উন্দলুসের পয়তাল্লিশজন ছেলে রয়েছে। এর মধ্যে বিলাসী আর অপব্যয়কারী তো সবাই।
সুলতানা আয়নার সামনে গিয়ে বসলো। আরেকটি পাকা চুল তার নজরে পড়লো। মুখটা যেন অভিমানে ফুলে উঠলো।
তুমি যাও। যারিয়াব যদি ব্যস্ত না থাকে ওকে বলো সুলতানা ডেকেছে। সুলতানা খাদেমাকে বলে আবার আয়নার দিকে মনোযোগ দিলো।
খাদেমা চলে যাওয়ার পর সুলতানা প্রথমে আয়নার সামনে গেলো। নিজের চেহারা মনোযোগ দিয়ে দেখলো। তারপর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।
একটু পর কামরায় পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো। যারিয়াব হাসি মুখে কামরায় ঢুকলো। কিন্ত সুলতানার মুখে সেই হাসি নেই।
চিন্তিত মনে হচ্ছে সুলতানা! যারিয়াব বললো এবং তাকে দুই বাহুতে জড়িয়ে টেনে এনে পালংকে বসিয়ে দিলো বললো, আমার মুখটা এভাবে মনোযোগ দিয়ে দেখছো কেন?
গতকাল যখন তুমি আমার কাছে এসেছিলে তখন তো তোমার চেহারায় এমন বার্ধক্যের ছাপ দেখিনি। আজ সেটা দেখা যাচ্ছে। সুলতানা চিন্তিত মুখেই বললো।
তোমার খাদেমা আমাকে বলেছে তুমি আজ বেশ পেরেশান। যারিয়াব বললো, সে এর কারণও বলেছে যে, তোমার মাথা থেকে আজ পাকা চুল উদ্ধার করেছে। এই পাকা চুল আবিস্কারের আগে তুমি তোমাকে এবং আমাকে যুবকই মনে করতে। নিজের বার্ধক্যের অনুভূতি-উপলব্ধি তোমার ভেতরটা এমনভাবে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে যে, তোমার চোখে এখন আমাকেও বুড়ো লাগছে।……
আমরা সত্যিই বার্ধক্যের উপনীত। এতে তো দুশ্চিন্তার কোন কিছু নেই। বার্ধক্য মানুষের ব্যক্তিত্ববোধকে শুধু বাড়ায়ই না তীক্ষ্মও করে। বার্ধক্য আসার আগে তো মানুষ পুর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারে না। আমি কিন্তু বার্ধক্যে পৌঁছে নিজের মধ্যে পূর্ণতা অনুভব করছি।
সুলতানা আরো পেরেশান আর অস্থির হয়ে গেলো। তার মাথা যারিয়াবের বাস্তব দর্শন গ্রহণ করছে না। সে যারিয়ারের কাছেই শুনতে চায়, সে বয়স্কা হয়নি। তার প্রয়োজন সান্ত্বনার।