সুলতানা মালিকায়ে তরূবের বয়ষ এখন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। আব্দুর রহমানের বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। যারিয়াবেরও একই বয়স। সুলতানার একমাত্র ছেলে আব্দুল্লাহ উনিশ বিশ বছরের যুবক।
আব্দুর রহমানের চিন্তা-ভাবনা ও স্বভাবে কিছুটা পরিবর্তন এসেছ। যারিয়াবের মধ্যেও আগের সেই ধার ও তীক্ষ্মতা নেই।
আমীর আব্দুর রহমান হলেও কিছুদিন তো কার্যত: বাদশাহী করেছে যারিয়াব। তার মুখের জাদু আর সুরের মুগ্ধতা দিয়ে আমীর আব্দুর রহমানকে বাদশাহ বানিয়ে দিয়েছে। তার মাথায় শাহেন শায়িতের ভূত সাওয়ার করে দিয়েছে।
উন্দলুসের ফৌজে ছিলো কিছু ইসলামী গণতন্ত্রকামী এবং স্বাধীনতাকামী সেনা কর্মকর্তা। যারা আব্দুর রহমানের মাথা থেকে কোন এক সময় বাদশাহী এর ভূথ নামাতে সক্ষম হয়। আর না হয় আব্দুর রহমানের শাসনামলেই উন্দলুস খ্রিষ্টানদের দখলে চলে যেতো।
যারিয়াবের তীক্ষ্ম মেধার প্রশংসা সব ঐতিহাসিকই করেছেন। সে বেশ কয়েক বছর পর এটা উপলব্ধি করতে পারে যে, এখানে সালারে আলা উবাইদুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ, হাজিব আব্দুল করীম, সালার আব্দুর রউফ, মুসা ইবনে মুসা, সালার ফারতুন এবং আব্দুর রহমানের ভাই মুহাম্মাদের মতো। বিচক্ষণ মর্দে মুজাহিদদের সঙ্গে আর বেশি দিন পেরে উঠবে না। মহলে তার যে অবস্থান সেটা থেকেও সে বঞ্চিত হয়ে যাবে।
সে তো তার অবস্থান এতো উর্দুতে নিয়ে গিয়েছিলো যে, যাকে সে চাইতো তাকে আমীরে উন্দলুসের চোখে আকাশে উঠিয়ে দিতে এবং যাকে খুশি তাকে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করতো।
কিন্তু তার উপলব্ধি হওয়ার পর নিজ থেকে সে তার অবস্থান কিছুটা নিচে নামিয়ে ফেলে। সে তার সুর সঙ্গীতে মগ্ন হয়ে যায়। তবে সুলতানার প্রেম সে তার মন-মস্তিষ্ক থেকে কখনো নামাতে পারেনি। সুলতানা তার জন্য ছিলো এক উম্মাদনার নাম।
আমার সুর ছন্দে সেই প্রাণ ও সেই আয়েশ আমি খুঁজে পাই না যা তোমার রূপের মাধুরীতে আমি অনুভব করি। যারিয়ার সুলতানাকে সবসময় বলতো। আমি এখনো তোমার হাসির জলতরঙ্গ আমার সুর তরঙ্গে সৃষ্টি করতে পারিনি।
যারিয়াবের সামনে সুলতানা থাকলে তার চেতনার জগতই যেন লোপ পেয়ে যেতো। সুলতানা তখন তাকে বলতে শুরু করতো, তুমি এখন বিয়ে করে নাও।
আমার মনে ও আমার জীবনে অন্য কোন মেয়ে আসতে পারবে না। যারিয়াব একদিন তাকে শেষ সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দেয়। এটা পঁচিশ বছর আগের কথা। সে তখন বলে, তুমি থাকলে আমার সবকিছু আছে।
কিন্তু আমি তো আমীরে উন্দলুসের। সুলতানা তাকে বলতো, তুমি তো আমাকে হেরমের চার দেয়াল থেকে ছিনতাই করে নিতে পারবে না। তোমার সাথে আমি পালিয়ে যেতে পারি। কিন্তু পালিয়ে যাবো কোথায়? কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেয়ার আগেই ধরা পড়ে যাবো আমরা। তখন আমাদের পরিণাম কী হবে। সেটা তো তুমি ভালো করেই জানো।…
আমাকে নিয়ে ঘর-সংসার বাঁধার স্বপ্ন তাই তুমি মন থেকে দূর করে দাও। কিন্তু আমাকে সবসময় তোমারই মনে করো। আমি কি তোমাকে শত সহস্রবার আমার জায়গীরে নিয়ে যাইনি? দিনে কিংবা রাতের নির্জনতায় তোমার ও আমার দেহের মাঝখানে আর কাউকে আমি রেখেছি? না কখনো কল্পনা করতে পেরেছি? তোমার কাছেই আমি আমার কাংখিত আনন্দ আর তৃপ্তি পাই। এটাই আমাকে বাঁচার প্রেরণা দেয়।
এক সময় তো সবার জীবনেই পরিবর্তন আসে। সাবই বদলে যায়। পরিবর্তন আসে স্বভাবে চরিত্রে এবং চিন্তা-ভাবনাতেও। এর মধ্যে উন্দলুসের নদীগুলোর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে বহু পানি। উন্দলুসের অলি-গলি, ময়দান ও উপত্যকায় ঝরে গেছে বহু রক্ত। কিন্তু সুলতানার স্বভাবে কোন পরিবর্তন আসেনি।
তার জীবেন শুধু এতটুক পরিবর্তন এসেছে, সে এক সন্তানের মা হয়েছে। সে উন্দলুসের সম্রাজ্ঞী হওয়ার স্বপ্ন দেখতো। তার এই স্বপ্ন এক মারিচিকা ছাড়া কিছুই প্রমাণিত হয়নি। এজন্য সে খ্রিষ্টান নেতাদের সাথে সবসময় সম্পর্ক রেখেছে। তাদের প্রতিটি ষড়যন্ত্রে তার কালো হাত রয়েছে সবসময়।
আব্দুররহমানের সিংহাসন উল্টানোরও চেষ্টা করেছে। কিন্তু সফল হয়নি। ভয়ংকর কালনাগিনীর চরিত্র কখনো বদলায়নি। পঞ্চাশে এসেও তার এই রূপ কখনো ধারবিহীন হয়নি।
আসলে সুলতানা তার বয়সকালকেই মেনে নেয়নি।
এখনো সুলতানা নিজেকে যুবতীই মনে করে। তার রাজকীয় জীবনে তো কোন দুশ্চিন্তা বা পিছুটান নেই। চোখ মুখের সজীবতা এতটুকু ম্লান হয়নি। কমেনি মাথার চুলের উজ্জলতা।
একদিন তার এক খাদেমা তার মাথা আচড়ে দিচ্ছিলো। খাদেমা চিরুনি রেখে একটি চুল মাথ থেকে উঠালো, সুলতানা, উফ করে উঠলো। সে খাদেমাকে জিজ্ঞেস করলো,
কী ব্যাপার? মাথায় কি করেছো?
একটা পাকা চুল মাথা থেকে উপড়ে ফেলেছি।
মিথ্যা কথা। এখনই পাকা চুল? সুলতানা বললো।
বৃদ্ধা খাদেমা হেসে উঠলো এবং রূপালী বর্ণের চুলটি তার সামনে এনে রাখলো।
একটাই নয় মালিকা! খাদেমা বললো, আরো বেশ কয়েকটা আছে। আপনি তো স্বর্ণাকেশী। তাই পাকা চুলগুলো ভালো করে নজরে পড়ে না। এই তো এখানে কয়েকটা আছে।
কয়েকটা আছে? সুলতানা এমনভাবে বললো যেন তাকে তার কোন প্রিয়জনের মৃত্যুর সংবাদ দেয়া হয়েছে।
হ্যাঁ, মালিকায়ে তরূব! খাদেমা বললো, কয়েকটি পাকা চুলে এত বিস্ময়! আপনি এত ঘাবড়ে গেলেন কেন? চুল তো সাদা হবেই। একদিন মৃত্যুও হবে। যৌবন তো আমিও দেখেছি। আর এমন রূপ ছিলো আমার যে, আমীর, ওযীর, সালাররা থ হয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখতে।