পথে পড়লো বিদ্রোহী লশকরের তাবুর শিবির। শিবির পুরোটাই খালি। সকাল হওয়াতে নাস্তা তৈরির জন্য আগুন জ্বলছে। হুকুম পেয়ে সিপাহীরা পুরো শিবিরে আগুন লাগিয়ে দিলো। বিদ্রোহীর সৈন্যরা শহরের সামনে প্রচন্ড ভিড় করে আছে। এই ভিড় থেকে হৈ চৈ করে আওয়াজ উঠলো,
আসছে… হামলা আসছে। ফৌজ আসছে। এতে কর্ডোভার ফৌজ, কর্ডোভার ফৌজ আসছে।
লোকদের মধ্যে হুলুস্থুল পড়ে গেলো। দিশেহারা হয়ে একে অপরকে মাড়িয়ে দিক-বিদিক হতে লাগলো।
মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম হামলে পড়ার হুকুম দিলেন। ফৌজ ছড়ানো ছিটোনো বিন্যাস অক্ষুণ্ণ রেখেই সপাটে ছুটে আসতে লাগলো। বিদ্রোহী সন্ত্রাসলীরা এদিক-ওদিক পালাতে শুরু করলো। কিন্তু পালানোর সময় নেই, আর পালানোর পথও ফৌজ আটকে দিয়েছে। এটা ভোলা এবং সমতল এক ময়দান।
যে সব বিদ্রোহীর কাছে অস্ত্র রয়েছে তারা লড়াইয়ে নেমে গেলো। আর যারা শহরের দরজা দিয়ে ভেতরে যেতে পারলো তারা ভেতরে চলে গেলো। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন ভিড়ের চাপে পায়ের নিচে পড়ে পিষ্ট হয়ে গেলো।
বিদ্রোহী যারা লড়তে এলো তারা বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই লড়লো। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না। সবগুলো মারা পড়লো। ইতোমধ্যে শহরের ভেতর থেকে বিদ্রোহীরা শহরের ফটক লাগিয়ে দিলো। আর প্রাচীরের ওপর থেকে শুরু হয়ে গেলো তীর বৃষ্টি।
ইবনে ওসীমের এই ফৌজ যেমন চারদিকে ধুলো উড়িয়ে তুফানের মত আসছিলো তেমনি তুফানের মতোই পিছু হটে গেলো।
সন্ত্রাসীদের অর্ধেক সৈন্য মারা পড়েছে। কিন্তু মুহাম্মাদ ইবনে ওসীমের কাছে এত বড় শহরকে অবরোধ করার মতো তো সৈন্যবল ছিলো না।
***
মুহাম্মাদ ইবনে ওসৗম এক গাছতলায় বসে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলেন। আল্লাহ তাআলা তার দুআ শুনলেন।
ইতিহাসে একে অলৌকিকতা বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় দিনই সংবাদ এলো, আব্দুর রহমানের ছেলে উমাইয়্যার নেতৃত্বে সেনা সাহায্য আসছে। ইবনে ওসৗম ঘোড়া সাওয়ার হয়ে তাকে সংবর্ধনা দিতে চলে গেলেন।
ইতিহাসে এটা উল্লিখিত হয়নি যে, উমাইয়্যা আব্দুর রহমানের কোন স্ত্রীর ছেলে। মুদ্দাসসিরা তখনো যুবতী। উমাইয়্যার বয়স তখন বিশ একুশ বছর।
উমাইয়্যা তার ফৌজ নিয়ে যথা সময়ে পৌঁছে গেলো। মুহাম্মদ ইবনে ওসীম তাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। অনেক সময় আলিঙ্গনাবদ্ধ রাখলেন। যেন হারানো সন্তানকে খুঁজে পেয়েছেন তিনি। সেখানে দাঁড়িয়েই আকাশের দিকে হাত তুলে কান্নাভেজা কণ্ঠে ফুপাতে ফুপাতে বললেন,
রাব্বল আলামীন! জানতাম, তোমার এই বান্দা পাপিষ্ঠ হলেও তাকে তুমি তোমার অফুরন্ত সাহায্য থেকে বঞ্চি করবে না।
আব্বাজানকে বাধ্য করার পরই তিনি কিছু ফৌজ নিয়ে আমাকে টলয়টা পাঠিয়েছেন। উমাইয়্যা জানালো ইবনে ওসীমকে।
ইবনে ওসীম এখানকার আসল পরিস্থিতি সম্পর্কে উমাইয়্যা জানালেন। সে রাতেই টলটা অবরোধ করা হলো। শহরের দরজায় হামলা করা হলো। কিন্তু প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা তীরান্দাজরা কোন চেষ্টাই সফল হতে দেয়নি। প্রাচীরের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ করার চেষ্টা করা হয়। এটাও ব্যর্থ হয়।
অবরোধ অনেক দিন রইলো। কিন্তু সফল হলো না। উমাইয়্যা অবরোধ উঠিয়ে নেয়ার হুকুম দিয়ে দিলো। বিদ্রোহীরা এটা দেখে হয়রান হয়ে গেলো যে, কর্ডোভার ফৌজ শুধু অবরোধই উঠালোই না, ফৌজ ফিরে যাচ্ছে।
বিদ্রোহীদের নেতারা হৈ চৈ করে বলে উঠলো, এই ফৌজকে জীবিত ফিরে যেতে দেয়া হবে না। এদের পিছু ধাওয়া করো।
শহরের ফটক খুলে দেয়া হলো। হাজারো অশ্বারোহী ও পদাতিক এমনভাবে বের হলো যেন নদীর বাঁধ ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে।
কর্ডোভার ফৌজ ততক্ষণে কাট্রাড নামক পাহাড়ি এলাকার কাছে পৌঁছে গেছে। পেছনে পেছনে বিদ্রোহী সন্ত্রাসীদের আসতে দেখে উমাইয়্যা তার ফৌজকে পালানোর হুকুম দিলো।
ফৌজ পালানোর জন্য দ্রুত ছুটতে শুরু করলো এবং পাহাড়ি এলাকায় ঢুকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো। বিদ্রোহীরা তো এবার বাঘের মতো দুঃসাহসী হয়ে উঠলো। তাদের সওয়াররাও সপাটে ছুটে পাহাড়ে ঢুকে পড়লো।
যখন দুশমনের পুরো বাহিনী পাহাড়ে ঢুকে পড়লো তখন তাদের ওপর পাহাড়গুলোর ওপর থেকে তীরের বর্ষণ শুরু হলো।
মায়সারা নামে এক নওমুসলিমের পরামর্শে উমাইয়্যা বিদ্রোহী সন্ত্রাসীদের জন্য এই মরণঘাতের জাল বিস্তার করে।
খ্রিষ্টানরা জয়ের নেশায় বড়ই বোকামি করে বসলো এবং কমান্ডার মায়সারা ও উমাইয়্যার জালে পা দিলো। মায়সারার তীরান্দাযরা তাদেরকে বেছে বেছে মারতে শুরু করলো।
এরা পেছন দিকে ভাগতে চাইলে উমাইয়্যার সৈন্যরা শুরু করলো তীর আর পাথর বর্ষণ।
ঐতিহাসিকরা লিখেন,
কালট্রাডের পাহাড়ি এলাকায় খ্রিষ্টান বিদ্রোহী সন্ত্রাসীদের এত বেশি রক্ত ঝরেছে যে, ঘোড়ার খুরাঘাতে রক্তের ছাট উটতে লাগলো। হাতে গোনা দুচারজন বিদ্রোহী ছাড়া আর কেউ প্রাণ নিয়ে পালাতে পারেনি।
মায়সারা তখনো পাহাড়ের উচ্চতা থেকে তার ইউনিটের সেনাদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিলো। মায়সারা একজন প্রবীণ কমান্ডার হওয়ার পরও এত বেশি রক্ত ও লাশ দেখে এক পর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়ে যায়। আর তিন দিন পর মারা। যায়।
পরিকল্পনা মতো মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম তার বিজয়ী ফৌজ নিয়ে শহরে প্রবেশ করেন। টলয়টা শহর এখন নীরব, শান্ত এবং সন্ত্রাসী ও জঙ্গিমুক্ত।