একটু পর একে একে জানবাদের সবাই গুহার ভেতর চলে গেলো। পাথারগুলোর পেছন থেকে বিদ্রোহী সন্ত্রাসীরা উঠে দাঁড়ালো। এবার তলোয়ার আর বর্শার সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেলো। একটু পরই এ লড়াই খতম হয়ে গেলো।
ভেতরের সবাই মারা পড়লো। কয়েকজন গুরুতর যখমী হলো। তিন জানবায শহীদ হলো এবং দুজন হলো যখমী। জানবায়দের কমান্ডার এক আহত বিদ্রোহীকে জিজ্ঞেস করলো, তোমাদের নেতা হাশিম কামার কোথায়?
হাত দিয়ে ইঙ্গিত করলো একটি লাশের দিকে। তার দেহে দুটি তীর বিদ্ধ হয়েছে। তার লাশ টেনে বাইরে বের করা হলো।
মাঝরাত পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। ইবনে ওসীম বেশ অস্থির হয়ে আছেন। তিনি বার বার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছেন। তার সামনে তিন কমান্ডার রয়েছে। বাইরে ফৌজ প্রস্তুত হয়ে বিশ্রাম করে নিচ্ছে।
অবশেষে প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হলো। ঘোড়ার খুর ধ্বনি শুনতে পেয়েই মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম ওদিকে দৌড়ে গেলেন। বাইরে দশজন নৈশহামলাকারী ও পথ নির্দেশক দুটি সিপাহী দাঁড়িয়ে আছে।
তাদের সামনে শোয়ানো তিন শহীদের লাশ ও দুই যখমী। এদের একটু দূরে আরেকটি লাশ পড়ে আছে।
এটাই কি হাশিম কামারের লাশ। ইবনে ওসীম জিজ্ঞেষ করলেন।
হ্যাঁ, টলয়টার সন্ত্রাসীদের হোতা ছিলো এই হাশিমই।
এর লাশ শহরের দরজার সঙ্গে ঝুলিয়ে দাও। ইবনে ওসীম হুকুম দিলেন, যাতে সব খ্রিষ্টান ও ওদের সন্ত্রাসীরা দেখতে পায়। ভোরের আগেই এর লাশ ঝুলিয়ে দিয়ে আসে। তারপর আমরা ফ্লোরাকে দেখবো।
হাশিমের লাশ একটি ঘোড়ায় উঠানো হলো। এক অভিজ্ঞ গুপ্তচর তার লাশ নিয়ে যাচ্ছে। সে খ্রিষ্টানদের ছদ্মবেশ নিয়েছে। সে বিদ্রোহীদেরকে বলবে, সেও বিদ্রোহীদের একজন। অনেক দূর থেকে এসেছে।
এই গুপ্তচরের দ্বিতীয় কাজ হলো, সে বিদ্রোহী ফৌজের মধ্যে এটা ছড়িয়ে দেবে যে, কামার হাশিমের লাশ শহরের দরজায় ঝুলছে। রাতে কর্ডোভা থেকে বড় শক্তিশালী এক ফৌজ এসেছে। কিন্তু এরা কোথায় তাঁবু ফেলেছে এটা কারো জানা নেই।
***
টলটায় সকাল হচ্ছে। এর মধ্যে বিদ্রোহীদের ঘরে এ খবর পৌঁছে গেছে যে, তাদের আধ্যাত্মিক নেতা ও বিদ্রোহের আসল প্রাণ কামার হাশিমের লাশ শহরের ফটকের সামনে একটি গাছে ঝুলে রয়েছে।
যে লোক লাশ ঝুলিয়েছে, তাকে বলা হয়েছিলো, শহরের ফটকে লাশ ঝুলাতে। কিন্তু সে এসে দেখে ফটকে প্রহরী রয়েছে। তাই সে তোক নিঃশব্দে গাছের মধ্যে লাশটি ঝুলিয়ে দেয়।
বিদ্রোহীদের মধ্যে এখন আর আগের সেই স্বতঃস্বচূর্ততা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
ফ্লোরার ব্যাপারে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হলো, সে মরা গেছে। ফ্লোরার সাথে যার প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে সে তার লাশ এখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।
এটাও ছড়িয়ে দেয়া হলো, ফ্লোরা আসলে একটা থোকা ছিলো। সে বিয়ে ছাড়াই এক লোককে তার স্বামী বানিয়ে নিয়েছে। এর আগে তার সাথে আরেক পুরুষের সম্পর্ক ছিল। সেই হিংসার বশবর্তী হয়ে ফ্লোরাকে হত্যা করেছে।
মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম খ্রিষ্টানদের ছদ্মবেশে কিছু লোককে শহরে পাঠিয়ে দেন। সকাল হতেই তারা ইবনে ওসীমকে জানায়, তার এই পরিকল্পনাকে মহান আল্লাহ সফল করে দেখিয়েছেন।
শহরের বাইরে বিদ্রোহীদের অর্ধেক লশকর তাঁবু ফেলে অবস্থান করছিলো। এরা হাশিমের লাশ দেখতে চলে গেছে। শহরের দরজার বাইরে এরা লাশ দেখার জন্য বিশাল ভিড়েরর সৃষ্টি করেছে। কেউ এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম তার সামান্য সংখ্যক ফৌজ প্রস্তুত রেখেছেন। রাতে ইবনে ওসীম ফৌজের উদ্দেশ্যে বলেন,
তোমরা আল্লাহর সিপাহী। নিজেদের ও দুশমনদের সংখ্যার দিকে তোমরা দৃষ্টি দিয়ো না। আল্লাহর রাসূল কখনো দেখেননি, মুসলমানদের চেয়ে কাফেরদের সৈন্য সংখ্যা কম না বেশি। কাফেরদের সংখ্যা সবসময়ই বেশি ছিলো আর জয় হয়েছে মুসলমানদেরই। আজ রাসূলে খোদার মহান রূহ নিজেদের বুকে জাগ্রত করে নাও।…
এটা মনে করো না খ্রিষ্টানরা তোমাদের ওপর বিজয় লাভ করছে। বরং আসল ব্যাপার হলো, খ্রিষ্টানরা ইসলামের ওপর বিজয় লাভ করছে। এটা দেখছো না যে, কর্ডোভার মহলগুলো ভোগবিলাসে ডুবে আছে। শাসকরা কী করে বেড়াচ্ছে? এরা দুনিয়ার পূজারী। এই দুনিয়াকেই সবকিছু মনে করে। কিন্তু তোমরা আল্লাহর প্রিয় পাত্র হওয়ার জন্য ব্যকুল।….
তোমাদের প্রকৃত জীবন তো এই জীবনের পর শুরু হবে। বিদ্রোহীদের কাছে আমরা একবার পরাজিত হয়েছি। সে পরাজয়কে পরম বিজয়ে রূপান্তরিত করতে হবে আমাদের। টলয়টা এখন ঐ কাফের সন্ত্রাসীদের দখলে। ওরা মুসলমানদেরকে যে হিংস্রতার টার্গেটে পরিণত করেছে সেটা তোমরা আজ হারে হারে টের পাচ্ছে। তাই তোমরা কি এই চরম অপমানের প্রতিশোধ নেবে না?
আমরা প্রতিটি রক্তের ফোঁটার প্রতিশোধ নেবো। আমরা লড়বো, মরবো। ফৌজ শ্লোগান দিয়ে উঠলো, কর্ডোভা থেকে সাহায্য না এলে কর্ডোভার সিংহাসন উল্টে দেবো। আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠা করবো। আমাদের শহীদ ভাইদের রক্তের হিসাব চুকিয়ে দেবো।
এরপর আর মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম কিছু বলতে পারলেন না। কারণ, খবর এসেছে! কামার হাশিমের লাশ দেখতে বিদ্রোহীরা লাশের কাছে ভিড় করছে।
তিনি ফৌজকে তৎক্ষণাৎ কোচ করার হুকুম দিলেন।
ব্যবধান বড় জোড় দুই মাইল। তিনি তার ফৌজকে ছড়িয়ে দিলেন। এখন ফৌজ এক মাইল লম্বা সারিতে সারিবদ্ধ হয়ে এগুচ্ছে। ঘোড়ার গতি পদাতিক সিপাহীর সমান রাখা হলো। হামলার নেতৃত্ব রইলো মুহাম্মাদ ইবনে ওসীমের হাতে।