এই ঘটনাই টলয়টার খ্রিষ্টানদেরকে আগুন উত্তপ্ত করে দেয়। পরিণামে সেখানে এখন সশস্ত্র বিদ্রোহ চলছে। কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে ওরা নৈশ হামলা ও গেরিলা হামলা। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে, বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব অভিজ্ঞ কোন সেনা কর্মকর্তার হাতে রয়েছে। মারীদার মতো পুরো শহরবাসী অন্ধের মতো বিদ্রোহ করে বসেনি। ওরা খুব সতর্ক ও ভেবে চিন্তো পা ফেলছে।….
এতটুকু জানা গেছে যে, হাশিম কামার নামে এক লোক আপাতত এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিচ্ছে। তার নির্দেশেই বিদ্রোহীরা সামনের দিকে পা ফেলছে।
তবে সে কেথায় আছে, কোথায় তার অবস্থান এটা জানা যায়নি। জানা গেছে। ফ্লোরা নামের অতি সুন্দরী এক যুবতী খ্রিষ্টানদের রক্তে আগুন ধরিয়েছে।
তাকে ওরা মরিয়ম ছানী বলে থাকে। শহরের খ্রিষ্টানরা রীতিমতো ফৌজ বনে গেছে। কারো কথাই ওরা শুনছে না। আমাদের ফৌজি দল দেখলে ওরা ঘরে চলে যায়। কিন্তু পেছন থেকে হামলা করে বসে। একাকি কোন ফৌজ পেলে তো ওরা তাকে শেষ করে দেয়।
বিদ্রোহীরা কি রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুট করার চেষ্টা করেছে? আব্দুর রহমান জিজ্ঞেস করলেন।
না আমীরে উন্দলুস।
ওরা কি নিয়মিত ফৌজের মতো সুশংখল?
না আমীরে উন্দলুস! সুশৃঙ্খল ডাকাতদল ও লুটেরা দলের মতো ওদের কৌশল?
আব্দুর রহমান পয়গামবাহকে আরো কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করে তাকে শাহী মেহমান খানায় পাঠিয়ে দিলেন। তারপর দারোয়ানকে ডেকে বললেন,
এখনই সিপাহসালার উবাইদুল্লাহ ও ওযীর হাজিব আব্দুল করীমকে আসতে বলো।
দারোয়ান কামরা থেকে বেরিয়ে গেলো।
***
টলয়টা থেকে দুই তিন মাইল দূরের এক পাহাড়ি এলাকা। যেখানে ঘন ঘন জঙ্গল রয়েছে। কোথাও কোথাও চোরা ভূমিও রয়েছে। এর মধ্যে পাহাড়ে ঘেরাও করা কিছু জায়গা রয়েছে। সেখানকার পথ-ঘাট অতি কঠিন। ওখানে বিশাল বিশাল পর্বতগুহাও রয়েছে।
একটি গুহা বেশ আলোকিত। প্রদীপ বা মশাল জ্বলছে ভেতরে। কামার হাশিমের হেড কোয়ার্টার। গুহায় এক লোক বাইরে থেকে এসে ঢুকলো। তাকে দেখে এদিক-ওদিক থেকে কয়েকজন একত্রিত হলো। ওদের মধ্যে একজন মেয়েও আছে। সে হলো ওদের কাছে মরিয়াম ছানী- ফ্লোরা।
বিদ্রোহীদের মনোবল তুঙ্গে আছে তো? কী খবর নিয়ে এসেছ?
আমাকে শুনতে দাও আগে। ফ্লোরা বললো।
ফ্লোরা তাড়াহুড়া করো না। কামার হাশিম বললো, তুমি এখনো বয়সে অপরিণত। বিদ্রোহ ও লড়াইয়ে আবেগ কোন কাজে লাগে না? সে আগন্তুক লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো, বলো কী খবর নিয়ে এসেছো?
সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছে। লোকটি বললো, আপনার দিক নির্দেশনা প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। তাজা খবর হলো, মুসলমানদের এক পয়গামবাহক কর্ডোভা চলে গেছে। ওখান থেকে ফৌজ তো অবশ্যই আসবে। টলয়টায় যে সেনাদল আছে সেটা তো আমরা তাড়াতাড়িই শেষ করে দিতে পারবো। কিন্তু কর্ডোভার ফৌজ এলে তো মুশকিল হয়ে পড়বে।
আমাদেরকে ফৌজের মতো সুশৃংখল হতে হবে। কামার হাশিম বললো, আমরা লোকদের কাছে এখনই পয়গাম পৌঁছে দিচ্ছি, সবাই যেন অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকে। হুকুম পেলেই যেন ফৌজের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এবং দুশমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
গুহায় হাশিমের আরো যেসব লোক ছিলো তাদেরকে বললো,
টলয়টার বাইরে অনেক সশস্ত্র বিদ্রোহীকে প্রস্তুত রাখতে হবে, যাতে কর্ডোভার ফৌজকে টলয়টা থেকে অনেক দূরে থাকতেই বাঁধা দেয়া যায়।
কয়েক দিনের মধ্যেই টলয়টার বাইরে এক ফৌজ তৈরি হলে গেলো।
টলয়টার গভর্ণর মুহাম্মাদ ইবনে ওসীমেরই দায়িত্ব শহরের নিরাপত্তা রক্ষা করা এবং নৈশ হামলা ও গেরিলা হামলাকারীদের পাকড়াও করানোও তার দায়িত্ব।
মুহাম্মাদ ইবনে ওসীমের হেড কোয়ার্টার শহরের কাছেই এক সুদৃশ্য জায়গায়। তার কাছে খবর পৌঁছেছে, টলয়টা থেকে দুই তিন মাইল দূরে খ্রিষ্টানরা রীতিমতো এক ফৌজ তৈরি করে নিয়েছে। সম্ভবত: এরা টলয়টার ওপর হামলা করে বসবে।
যদি ওরা হামলা করে তাহলে টলয়টার শহরবাসী ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভয়ংকর নাশকতার সৃষ্টি করবে। তখন পুরো টলয়টা বিদ্রোহীরা দখল করে বসবে।
মুহাম্মাদ ইবনে ওসীমের কাছে খুব স্বল্প সংখ্যক ফৌজ রয়েছে। হাতে গোনা কয়েকটি ইউনিট মাত্র। তিনি হুকুম দিলেন,
এখনই ফৌজের পূর্ণ এক ইউনিট প্রস্তুত হয়ে যাও।
সেনা ইউনিট প্রস্তুত হয়ে গেলো। ইবনে ওসীম নিজের হাতেই নিলেন ফৌজের নেতৃত্ব। খ্রিষ্টানরা যেখানে ফৌজ তৈরি করে বসে আছে সেদিকে কোচ করা হুকুম দিলেন।
ইবনে ওসীমকে খুব এটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হলো না। কারণ, তিনি এই আত্মতুষ্টিতে রয়েছেন যে, তিনি সাধারণ বিদ্রোহীদের দমন করতে যাচ্ছেন।
তিনি যখন বিদ্রোহীদের দলের সামনে পড়লেন তখনো দেখলেন এর সংখ্যা অনেক কম। তিনি হুকুম দিলেন একটাও যেন জীবিত পালাতে না পারে।
তার ইউনিটের সৈন্যরা সেদিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো। বিদ্রোহীরা কিছুক্ষণ বেশ জমে লড়ে গেলো। তারপর পিছু হটতে লাগলো। মুসলিম ফৌজও তাদের পিছ ধাওয়া করলো। আচমকা মুসলিম সেনাদের ওপর এক পার্শ্ব থেকে এবং পেছন থেকে এক দল খ্রিষ্টান ফৌজ হামলে পড়লো। অর্থাৎ তারা এতক্ষণ লুকিয়ে ছিলো। মুসলমানদেরকে পিছু হটার কৌশল নিয়ে লোভ দেখিয়ে তাদেরকে ঘেরাওয়ের মধ্যে নিয়ে এসেছে।
মুহাম্মাদ ইবনে ওসীম এ অবস্থা দেখে তার ফৌজকে পিছু হটার নির্দেশ দিলেন। তার সৈন্যরা লড়তে লড়তে পিছু তো হটতে পারলো, কিন্তু অর্ধেকই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেলো। তিনি বেশ কষ্টে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পারলেন।