***
৮২৯ খ্রিষ্ট সেপ্টেম্বরের এক রাত। আমীরে উন্দলুস তার খাস কামরায় আধো ঘুম আধো জাগরণ এ অবস্থায় আছেন। যারিয়াব মন মাতাল করা এক রাগ-সঙ্গীত ধরেছে। সুলতানা আব্দুর রহমানের কাছে এমনভাবে বসে আছে যেন সে আমীরে উন্দলুসকে তার কোলের গীতরে ঢুকিয়ে ফেলবে।
আমীরে উন্দলুস যখন সুলতানার দিকে তাকান সুলতানার হাসি আরো মাদকীয় হয়ে উঠে এবং তার চোখে দুটোকে নেশাকাতর করে তুলে। এক সন্তান ভুমিষ্ট করে সুলতানার রূপ-যৌবন যেন আরো বেড়ে গেছে।
দরজা হঠাৎ ধীর ধীরে খুলে গেলো। রেশমী পর্দা একটু দুলে উঠলো। সুলতানা কট কটে চোখে ওদিকে তাকালো। দারোয়ানকে দাঁড়ানো দেখতে পেলো। সুলতানা উঠে দরজা পর্যন্ত গেলো।
কোন হ্যায়? আব্দুর রহমান নেশাকাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন।
দারোয়ান! সুলতানা বললো বিরক্তভরা কণ্ঠে, বলছে টলয়টা থেকে পয়গামবাহক এসেছে।
গানের ছন্দে ছেদ পড়েছে। কামরায় নিঃস্তব্ধতা নেনে এলো। আব্দুর রহমান হাই তুললেন।
আমীরে উন্দলুস! যারিয়াব বললো, পয়গামবাহক সকালেও দেখা করতে পারবে। পয়গাম জরুরি হলেও ঘন্টা দুঘন্টা পরে এলেও সমস্যা নেই। আমীরে উন্দলুস তো কারো বন্দি নন।
বলে দাও সকালে আসতে। আব্দুর রহমান ঢুলতে ঢুলতে বললেন।
পয়গাম বাহককে বলে দাও, আমীরে উন্দলুস সকালে পয়গাম শুনবেন। যারিয়াব বললো।
দারোয়ান চলে গেলো। পয়গামবাহকও চলে গেলো। যারিয়ার ও সুলতানা দুজনে দুজনের দিকে তাকালো। দুজনের ঠোঁটে এক অর্থময় হাসি ফুটে উঠলো।
কামরা আবার সুরের ঝংকারে গম গম করে উঠলো।
এই পরিবেশ খুব বেশি সময় স্থায়ী হলো না। হঠাৎ দরজা খুলে গেলো। এবার পর্দা দুলে উঠলো না, বরং এক দিকে স্যাঁৎ করে সরে গেলো। আমীরে উন্দলুস, যারিয়াব ও সুলতানা তিনজনই চমকে উঠে ওদিকে তাকালো।
এখন যারিয়াব ও সুলতানার ভাব সম্পূর্ণ অন্যরকম। দুজনই থতমত খেয়ে গেছে। কারণ, এখন বিনা অনুমতিতে যে কামরায় এসেছে সে আমীরে উন্দলুসের ছেলে উমাইয়্যা। বিশ/একুশ বছরের এই যুবক নায়েবে সালার।
আমি কি আপনাকে সম্মানিত পিতা বলবো, না আমীরে উন্দলুস বলবো? উমাইয়া তীক্ষ্ম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
কী হয়ে গেলো তোমার উমাইয়্যা? আব্দুর রহমান উঠতে উঠতে বললেন, এতো রেগে আছো কেন?
টলয়টার বিদ্রোহী সন্ত্রাসীদেরকে কি এই খরব পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ওরা যেন কাল সকাল থেকে বিদ্রোহ আর সন্ত্রাসী কর্মকান্ডা শুরু করে? কারণ, এখন আমীরে উন্দলুস গান আর রাগ-সঙ্গীতের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। টলয়টা থেকে পয়গামবাহক এসছে, তাকে বলা হয়েছে ওকে সকালে এসে পয়গাম শোনাতে?
আরবের পবিত্র ভূমি তো এমন বেয়াদব সন্তানকে জন্ম দেয় না। তুমি কি আদব কায়দা ভুলে গেছো? আব্দুর রহমান উন্মা প্রকাশ করলেন।
আপনাকে আদব কায়দা দেখানোর সময় এটা নয়। আমার সামনে এখন সে আদব রয়েছে যা দুশমনকে দেখাতে হবে। যুদ্ধের ময়দানের আদব। মুহতারাম আব্বাজান! আমার এজন্য কোন অনুতাপ হচ্ছে না যে, আমি আপনার সামনে ভদ্রতা বজায় রেখে কথা বলতে পারছি না।……..
কিন্তু আমি অনাগত ইতিহাস ও আমার স্বাধীনতার পবিত্র চেতনার সঙ্গে অভদ্রতা করতে পারবো না। আপনার মৃত্যুর পর মানুষ আমার দিকে আঙ্গুল উঠিয়ে বলবে, এই ছেলের বাপ সালতানাতে উন্দলুসের অস্তিত্বের শিকড়…. দুর্বল করে দিয়ে গেছে।
তুমি আসলে কী বলতে এসেছো? উমাইয়াকে জিজ্ঞেস করলেন আব্দুর রহমান ঝাঝালো গলায়।
উমাইয়া কামরার বাইরে গেলো। পর মুহূর্তেই সঙ্গে এক লোক নিয়ে আসলো। তার কাপড় চোপড় ও চোখে মুখে ধূলোর আস্তরণ জমে আছে। তার মাথা মাঝে মধ্যে ঝুলে পড়ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ক্লান্তিতে সে দাঁড়াতে পারছে না।
আপনারা এখান থেকে চলে যান। উমাইয়্যা যারিয়াব ও সুলতানাকে বললো।
মুহতারাম আব্বাজান! উমাইয়্যা এবার কিছুটা নরম গলায় বললো, এই পয়গাম বাহক টলয়টা থেকে এসেছে। এক্লান্তিতে এবং চরম হতাশায় ভেঙ্গে পড়তে পড়তে আমার কাছে এসেছে। বলেছে, আমীরে উন্দলুস অতি জরুরি এক পয়গাম শুনতে চাচ্ছেন না। লোকটি এত দ্রুত এসেছে যে, রাতেও ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে কাটিয়েছে।…..
নিজের অতি প্রয়োজনীয় বিশ্রামও সে বিসর্জন দিয়েছে। একটি ঘোড়া তো তাকে নিয়ে অবিরাম ছুটতে ছুটতে মরেই গেছে। এক মুসাফিরের ঘোড়া ধার করে নিয়েছে। চরম ক্ষুধা আর তৃষ্ণা নিয়ে সে এখানে পৌঁছেছে। অথচ এখানে এসে … ওর পয়গাম আগে শুনুন।
সংক্ষেপে তোমার পয়গাম শোনাও। আব্দুর রহমান পয়গাম বাহককে বললেন।
টলয়টার খ্রিষ্টানরা বিদ্রোহ করে বসেছে। পয়গাম বাহক বললেন, একে তো আমাদের ফৌজ অতি কম। তারাও সেসব ফৌজি চৌকি দূরদূরান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং যেগুলোতে সৈন্য সংখ্যাও নেহায়েত কম। সে গুলোর ওপর হঠাৎ খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীরা নৈশ হাশলা চালানো শুরু করে। ফৌজি রসদের কাফেলার ওপর হামলা হতে থাকে।…..
এমনকি দিনের বেলাও টহল সেনাদলের ওপর গেরিলা হামলা চালাতে থাকে খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীরা। ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয় হয়। কিন্তু নৈশ হামলা ও ওদের লুটপাট বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। তাদের এসব নাশকতামূলক কর্মকান্ড চলতেই থাকে।…….
কয়েকদিন আগে খ্রিষ্টানদের কবরস্থানে এক ভেল্কি বাজির খেলা দেখায় তারা। বোকা, মুখ খ্রিষ্টানরা এটাকে মনে করে কুমারী মরিয়ম তাদেরকে কিদ্রোহ করার পয়গাম দিয়ে গেছে।