সবচেয়ে বেশি পরাজয় ও হতাশা ফুটে উঠলো সেই তিন সুন্দরী পরিচারিকার চোখে মুখে, যাদেরকে আবদুর রহমান দৃষ্টির আড়াল হতে দিতেন না। সুলতানা এসে তাদের প্রাণপুরুষকে কেড়ে নিয়েছে।
সেদিন সুলতানা তাদের তিনজনকে তার কামরায় ডেকে পাঠালো। তিনজন বুক ভরা ঘৃণা নিয়ে তার কাছে গেলো।
তোমরা আমার কাছে এসে বসো। সুলতানা তাদের তিনজনকে একেবারে কাছ ঘেঁষে বসালো এবং বললো, আমি জানি, এখানকার সবাই আমার বিরুদ্ধে কানাঘুষা করছে। সেসব কিছু আমার কানেও পৌঁছে গেছে। কিছু তো তোমরাও বলেছো।
তিনজনই থতমত খেয়ে গেলো। তাদের চোখেমুখে ভয়ের ছায়া নেমে এলো। ভয় হলো, সুলতানা এখন চাইলেই তাদেরকে হেরেম থেকে বের করে দিতে পারবে। শাহে উন্দলুস তার হাতের পুতুল। তাদের তিনজনের ব্যাপারে কতলের হুকুমও নিতে পারবে সে।
তোমাদের চেহারা এমন ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করলো কেন? সুলতানা তাদেরকে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কি আমাকে নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছো? মন থেকে এ ধরনের ভাবনা দূর করে দাও। আমিও তোমাদেরকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করি না, তোমরাও আমাকে তোমাদের শত্রু মনে করো না।
তোমাদের মধ্যে কেউ এমন নেই যার মনে শাহে উন্দলুসের ভালোবাসা আছে। আমরা চারজনই শাহে উন্দলুসের ভালোবাসার কথা এজন্য উচ্চারণ করি যে, তিনি একজন বাদশাহ। আজ যদি তিনি নিহত হন এবং তার সিংহাসনে কোন বৃদ্ধ বসে যায়, তাহলে এই আমরা চারজনই তার প্রেম ভালোবাসায় বেহাল হয়ে যেতে থাকবো।
তোমরা আমার শক্তি দেখে নিয়েছে। আমি কি না করতে পারি। কিন্তু আমি তোমাদের বিরুদ্ধে ও হেরেমের কোন মেয়ের বিরুদ্ধেই বাদশাহর কাছে কোন অভিযোগ করবো না। কারো বিরুদ্ধে তার কানও ভারি করবো না।
তিন পরিচারিকার চেহারায় প্রাণ ফিরে এলো।
মুদ্দাসসিয়া! সুলতানা মুদ্দাসসিরা নামক পরিচারিকাকে বললো, শাহে উন্দলুস তোমাকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। তুমি তার স্ত্রী। তোমার প্রতিও তিনি কম আসক্ত নন। কিন্তু তুমি কি এটা বিশ্বাস করো তার অন্তরে তোমার ভালোবাস আছে এবং তিনি শুধু তোমারই?
আসলে তিনি কারোই নন। মুদ্দাসসিরা বললো, আমিও তার শুধু একলা স্ত্রী নই। আমাকে তিনি অন্যদের চেয়ে অধিক পছন্দ করেন বলে আমাকে বিয়ে করেছেন। এখন তুমি তার কাছে সবচেয়ে বেশি পছন্দের। তাই…..
কিন্তু আমি তার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে না। সুলতানা মুদ্দাসসিরার কথা কেড়ে নিয়ে বললো, বিয়ে ছাড়াই আমি তার কাছে থাকবো। তোমাদের তিনজনকেই আমি এ নিশ্চয়তা দিচ্ছি, তোমরা আমাকে তোমাদের শত্রু মনে করো না। আমি বলেছি একজন নারী আমি। তাই কোন নারীর মন আমার দ্বারা পদপিষ্ট হতে দেবো না…..
এখন তার সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আমার প্রতি। এ থেকে এটা বুঝে নিয়ো না, তাকে আমি তোমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি। এই মনোযোগ আমি তোমাদের দিকে ফিরিয়ে দেবো। আমার মনে এমন কোন ইচ্ছে নেই যে, তাকে একলা আমি দখল করে রাখবো। নিজেদের চেহারা থেকে হতাশা ও অভিমান ধুয়ে মুছে ফেলো।
সুলতানা ওদের সঙ্গে আরো কিছু কথা বললো। ওরা তিনজন যখন তার কামরা থেকে বের হলো তখন তাদের দৃষ্টিতে সুলতানা মালিকায়ে তরূব বা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রইলো না আর। সে হয়ে গেলো তাদের সহমর্মী। তাদের সখি বা বান্ধবী।
***
এটা একেবারেই অবিচার, জুলুম। গতকালও যাদের জন্য আপনি পাগল দিওয়ানা ছিলেন আজ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে আপনি শুধু আমার প্রেমেই মজে গেছেন। মালিকায় তরূব একদিন আবদুর রহমানকে বললো, আপনি শুধু একজন পুরুষ নন, আপনি বাদশাহও। আপনার তো হৃদয়ের বাদশাহ হওয়া উচিত।
কোন নারীর প্রতি এ জুলুম আমি সহ্য করতে পারবো না যে, তার প্রেম ভালোবাসাকে আপনি আস্তকুড়ে ছুঁড়ে মারবেন। আমি দুই তিন দিনের জন্য বিশেষ কাজে আমার জায়গীরে যাচ্ছি। আপনি মুদ্দাসসিরা, জারিয়া ও শিফাঁকে সেই প্রেম ও ভালোবাসা দিন যা আমার আসার আগে দিতেন। আর না হয় তাদের দীর্ঘশ্বাস আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারবে।
না, সুলতানা! আবদুর রহমান ব্যাকুল হয়ে বললেন, আমি তো দু তিন মুহূর্তও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না, আর তুমি দুই তিন দিনের কথা বলছো!
আমি আপনাকে এজন্য চাই না যে, আনি অনেক বড় বাদশাহ। সুলতানা বললো, না আপনাকে এজন্য ভালো লাগে যে, আপনার কাছে সোনা, রূপা, হীরা জহরতের বড় বড় ভাণ্ডার রয়েছে। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসাবে আপনাকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু যখন কোন নারী আপনার কারণে দুঃখ পায় তখন আমার ভালোবাসা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। দু তিন দিনের জন্য আমি এখান থেকে অনুপস্থিত থাকবো।
সন্ধ্যায় তার জায়গীরে পৌঁছে গেলো সুলতানা। যাওয়ার আগে আবদুর রহমানকে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। যেন আবদুর রহমানকে ছাড়া সে মুহূর্তকালও বাঁচবে না।
তার নিরাপত্তার জন্য আবদু ররহমান নিজের বডিগার্ডও পাঠিয়ে দিলেন। এরা রাতে সুলতানার বাড়ির চারপাশে প্রহরা দেবে। ইউগেলিসও গারোয়ানের ছদ্মবেশে সুলতানার সঙ্গে এসে গেলো। তার প্রতি কারো কোন সন্দেহ হলো না।
আমি মনে হয় সবদিক দিয়েই সফল। সুলতানা ইউগেলিসকে বললো, আমি মোটেও ভাবিনি, এ লোক নারীর ব্যাপারে এতই দুর্বল যে, দুনিয়া আখেরাত সবই ভুলে যাবে।