প্রাচীর ভাঙ্গার জন্য আরো দুদিন চেষ্টা করলেন। কিন্তু মুষলধারায় তীর বর্ষণের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। তখন খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) দারুণ ভাবনায় পড়ে গেলেন। চিন্তার সাগরে যেন ডুবে গেলেন। হঠাৎ তার মাথা দুলে উঠল, স্বাগতোক্তি করে বলে উঠলেন, হ্যাঁ, পেয়েছি। এ পন্থায়ই অগ্রসর হতে হবে।
কেল্লার প্রাচীরের কিছু দূরে এক উঁচু টিবি ছিল। সেখানে ও কেল্লার চার পাশে বিদ্যমান উঁচু উঁচু গাছে মুজাহিদদের আরোহণ করে সেখান থেকে অগ্নি তীর নিক্ষেপের নির্দেশ দিলেন। সা সা করে অগ্নিতীর কেল্লার ভিতরে গিয়ে পড়তে লাগল। কিন্তু না, তেমন কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হল না। কোথাও অগ্নিতীরে আগুন ধরল না। হই হুল্লোর বা বিশৃঙ্খলারও কোন আভাস পাওয়া গেল না। কারণ কেল্লার ভিতরে বাড়িঘর প্রাচীর থেকে অনেক দূরে। সেখানে অগ্নিতীর পৌঁছা অসম্ভব।
***
খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) ও ইয়ায ইবনে গানাম (রা.) কেল্লার ভিতরের কোন খবরই জানেন না। কেল্লার ভিতরে মুসলমান কোন চর থাকলেও বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছে না। আর বাইরে থেকেও কোন মুসলমান চর আরব খ্রিস্টানের ছদ্মবেশে ভিতরে যেতে পারছে না। কেল্লার প্রাচীরের উপরে দণ্ডায়মান খ্রিস্টান যোদ্ধারা তীর ধনুক আর বর্শা নিয়ে প্রথম দিন যে আগ্রহ স্পৃহার সাথে যুদ্ধ শুরু করেছিল আজও তারা সে অবস্থায়ই আছে।
খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) তার অধীনস্ত সালারদের এবং মুজাহিদদের ডেকে বলেছেন, আলেপ্পাকে তোমরা নিজেদের শহর মনে করবে। তাদের আত্মবিশ্বাস ও সাহস বৃদ্ধির লক্ষ্যে বলেছেন, শহরে কোন বিজ্ঞ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফৌজ নেই। এরা হয়ত কয়েকদিন যুদ্ধ চালিয়ে যাবে এবং বিশৃঙ্খলতার মাঝে ডাক চিৎকার করে শত্রুর মনে ভীতি সঞ্চার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু অবরোধের মাঝে স্থির থাকা বা অবরোধ ভেঙ্গে ফেলার ক্ষমতা এদের নেই। এরা অতিশীঘ্রই অস্ত্র সমর্পণ করে আমাদের আনুগত্য মেনে নিবে। বা এমন কোন ভুল করে বসবে যার কারণে তাদের উপর পরাজয় নেমে আসবে।
খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেন নি যে, অবরুদ্ধ খ্রিস্টান যোদ্ধাদের নেতৃত্বে রয়েছে এক রোমান সিপাহসালার আর তার সহযোগী হিসাবে আছে এক রোমান সামরিক অফিসার যে সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.)-এর নিকট হিমস বিজয়ের সময় বন্দী ছিল। মুসলমানরা এ কথা ভাবতেও পারেনি যে, তাদের মাঝে রয়েছে সম্রাট হিরাক্লিয়াসের এক স্ত্রী ও তার পুত্র।
কেল্লার ভিতরে আন্তোনীস আর রূতাসের অবস্থা সঙ্গিন। রাতে তারা একটু ঘুমাতেও পারছে না। তাদের ক্ষেত্রে এটা কোন কেল্লা বা কোন এক শহর বিজয়ের যুদ্ধ নয় বরং তাদের জীবন মরণ সংগ্রাম। আন্তোনীসের প্রতিজ্ঞা, সে একটি খ্রিস্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেই। আরব খ্রিস্টান যোদ্ধাদের নিয়ে সে সেই রাজ্যে দুর্ধর্ষ বাহিনী গড়ে তুলবে। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রথম পদক্ষেপ হল আলেপ্পাকে ধরে রাখা। এ প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রূতাস হল তার প্রধান। সহযোগী।
হিরাক্লিয়াসের পুত্র ইউকেলিসও নিরবে বসে নেই। এক হাত নিষ্ক্রিয় তাতে তার কোন আক্ষেপ নেই। বাকি এক হাত দিয়েই সে যুদ্ধ করতে পারে। সেও রাত দিন ব্যস্ত। ছুটাছুটি করছে। যোদ্ধাদের উৎসাহ দিচ্ছে। শহরের অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে আতঙ্কিত মানুষদের সমবেত করে বক্তৃতা দিয়ে উজ্জীবিত করছে। বলছে, ভয়ের কোন কারণ নেই। বিজয় আমাদের হবেই হবে। অল্পদিনে আমরা আল্লাহর পুত্র ঈসা মাসীহ এর রাজ্য কায়েম করতে যাচ্ছি। নিশ্চয় ঈসা মাসীহের সাহায্য আমাদের সাথে রয়েছে।
কয়েক রাত কেটে গেল সে তার মায়ের সাথে দেখা করার সুযোগ পেল না। কেল্লার প্রধান ফটকের উপরে যে কয়েকটি কক্ষ তৈরী করা হয়েছিল তাতেই সে রাত অতিবাহিত করে দিল।
***
আন্তোনীস, লীজা ও ইউকেলিস এক বাড়িতে থাকে আর রূতাস অন্য বাড়িতে থাকে। বাড়ি দুটি অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অত্যন্ত সুন্দর আদলে তৈরী। দেখলেই মনে হয় এ বাড়ি দুটি রোমান কোন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি মনের সকল মাধুরী দিয়ে তৈরী করেছিল। রূতাস তিন চার দিন পর পর লীজার বাড়িতে আসত। কিন্তু অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে সে লীজার বাড়িতে খুব কমই যায়। কারণ দিন রাত সারাক্ষণ তাকে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হয়।
আন্তোনীস, লীজা ও ইউকেলিস এক বাড়িতে থাকলেও আন্তোনীস এখন আর প্রত্যেক দিন বাড়িতে আসতে পারে না। দুতিন দিন পরপর ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে আসে। আন্তোনীস ও রূতাস সর্বক্ষণ কেল্লার প্রাচীরের চারদিকে ঘুরে বেড়ায়। যোদ্ধাদের নানা পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা দিতে থাকে। তাদের অবস্থা দেখে মনে হয় তারা যেন সর্বক্ষণ সর্বত্র থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করছে। খ্রিস্টান যোদ্ধাদের উৎসাহ দিচ্ছে। মনোবল বৃদ্ধি করছে। মাঝে মাঝে গভীর রাতে আন্তোনীস ক্লান্ত শ্রান্ত ও নেতিয়ে পড়া দেহ টানতে টানতে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পরই সে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে ও অস্ত্র নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। বাড়িতে আসলেও মনে হয় সে বাড়িতে নেই।
আন্তোনীস ও রূতাস রোমান বাহিনীর উচ্চ পদস্থ সালার। তাই তারা খুব ভালভাবেই জানে, তারা যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা যুদ্ধ করতে জানলেও সুশৃঙ্খলভাবে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্য তাদের নেই। তাই তারা বারবার দিক নির্দেশনার মুহতাজ। তারা কেল্লার প্রাচীরের উপর ঘুরে ঘুরে পরিস্থিতি দেখে এবং তার যোদ্ধাদের উৎসাহ দেয় যেন মুসলমানরা কিছুতেই প্রাচীরের নিকটবর্তী হতে না পারে। তাছাড়া তারা একদল সাহসী দুর্ধর্ষ যুবককে এমন প্রশিক্ষণ দিয়েছে যারা হঠাৎ কেল্লা থেকে বের হয়ে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করে অভাবনীয় ক্ষতি করে আবার নিরাপদে কেল্লায় ফিরে আসতে সক্ষম হবে।