এরপরও কয়েকদিন মেয়েটির সাথে ইউকেলিসের দেখা হয়েছে। মেয়েটি তার কবিলার সর্দারের কন্যা। রাতেও সে ইউকেলিসের নিকট এসেছে। দুজনে অভিসারে বেরিয়েছে। কখনো কেল্লার দেয়ালের পাশে নির্জন স্থানে গিয়ে বসেছে। আবার কখনো হাত ধরাধরি করে ঘুরে ফিরেছে। হৃদয় দেয়া-নেয়ার খেলায় তারা অনেক দূর চলে গেছে। ইউকেলিস আলেপ্পায় কি করছে? কি তার উদ্দেশ্য? কে কে তার সাথে এসেছে? এ সব কিছুই ইউকেলিস মেয়েটির নিকট বলে দিয়েছে। মেয়েটি ইউকেলিসের কথা শুনে তাকে আকাশ থেকে নেমে আসা কোন অবতার মনে করছে।
একদিন মেয়েটি কথা প্রসঙ্গে ইউকেলিসকে বলল, আমার মনের এক দুশ্চিন্তা, এক দুর্ভাবনা আপনি কিভাবে দূর করবেন? আপনারা যে বাদশাহী প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছেন তা যদি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তাহলে তো আপনি শাহজাদা হয়ে যাবেন। তখন কি আপনার নিকট আমার কোন মর্যাদা থাকবে? আমি কি আপনার পাশে গিয়ে দাঁড়াবার সুযোগটুকু পাব?
ইউকেলিস তখন শুধুমাত্র কথায় নয়, বরং মেয়েটির ললাটে প্রগাঢ় চুম্বন এঁকে দিয়ে সবলে বুকের মাঝে চেপে ধরে বলল, আমি সর্বদা তোমার নিকট তোমার মনের মানুষ হয়েই থাকব। তোমাকে কখনো ভুলব না।
***
আন্তোনীস যে রাতে যুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্ত করেছিল সে রাতে কবিলার যযাদ্ধারা অনায়াসে কেল্লার মুজাহিদদের কাবু করে ফেলে। মুজাহিদরা তাদের শয়ন কক্ষগুলোতে গভীর ঘুমে নিমগ্ন ছিল। মুজাহিদদের বন্দী করার জন্য যে সব যোদ্ধাদের নির্বাচিত করে আন্তোনীস ও রূতাস ট্রেনিং দিয়েছিল তারা তা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বাস্তবায়ন করল। তারা তাদের আক্রমণের অবকাশ না দিয়েই একটি বিরাট কক্ষে বন্দী করে ফেলল।
শহরের প্রধান ফটকে দুজন মুজাহিদ তাদের দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত ছিল। তারা বুঝতে পারল, শহরে বিদ্রোহ হয়েছে এবং তাদের সাথীদের বন্দী করেছে। তারা কাল বিলম্ব না করে সেখান থেকে পালিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখন তাদের উপর কয়েকজন বিদ্রোহী যোদ্ধা আক্রমণ করল। তারা প্রাণপণে যুদ্ধ করে জখমী হলেও সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হল। বহু কষ্টে তিন মাইল দূরে পৌঁছে এক বস্তি থেকে দুটি ঘোড়া নিয়ে মরুর বুক চিরে ছুটে চলল। উধ্বশ্বাসে মরুর দুরন্ত বায়ুকে পরাজিত করে বিদ্যুৎবেগে ছুটে চলছে।
প্রায় বিশ মাইল দূরে অবস্থিত কেল্লাসিরিন শহর। খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) সে শহরে অবস্থান করছেন। মজবুত কেল্লা বেষ্টিত বিরাট এই শহরটি খালিদ (রা.) আক্রমণ করে রোমানদের থেকে ছিনিয়ে এনেছিলেন। জখমী মুজাহিদ দুজন তাদের ক্ষতের কোন পরোয়া না করে তার পরদিন কেল্লাসিরিনে উপস্থিত হল। সোজা খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) এর নিকট পৌঁছে তাকে সংবাদ দিল, আলেপ্পায় আরব খ্রিস্টানরা বিদ্রোহ করেছে।
খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) সংবাদ পাওয়ার পর পরই সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.) এর নিকট একজন দূত পাঠিয়ে দিলেন এবং নিজে সৈন্য নিয়ে আলোর পথে রওনা হলেন। ঝড়ো হাওয়ার মত খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) আলেপ্পায় ছুটে এলেন। পশ্চাতে উট আর গরুর গাড়িতে করে অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ সামগ্রী পৌঁছার ব্যবস্থা করে এলেন।
অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) আলোয় পৌঁছে কেল্লার চারদিক পর্যবেক্ষণ করে বুঝলেন, সহজে এ কেল্লার পতন সম্ভব নয়। দূর দূরান্ত থেকে আগত কবিলার যোদ্ধারা কেল্লার প্রাচীরে তীর ধনুক আর বর্শা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সংখ্যা গুনে শেষ করার নয়। খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) এর সাথে চার হাজার মুজাহিদ। তিনি প্রাচীরের উপরে দণ্ডায়মান যোদ্ধাদের উপর তীর নিক্ষেপের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তার প্রতিউত্তরে কেল্লার উপর থেকে যেভাবে তীরবৃষ্টি শুরু হলো তাতে মুজাহিদ বাহিনী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না।
সবদিক চিন্তা করে খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.)-এর নিকট এক অশ্বারোহী দূত পাঠিয়ে সংবাদ দিলেন, আরো মুজাহিদ বাহিনীর দরকার। কারণ কেল্লাটি অত্যন্ত মজবুত আর খ্রিস্টান যোদ্ধারা অত্যন্ত সাহসী ও সংখ্যায় প্রচুর। সংবাদ পেয়ে আবু উবায়দা (রা.) সালার ইয়ায ইবনে গানাম (রা.)-কে পাঁচ হাজার অশ্বারোহী মুজাহিদসহ প্রেরণ করলেন।
খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) কেল্লার প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলতে ও কেল্লার পতনের ক্ষেত্রে দারুণ দক্ষ ছিলেন। এ জন্য তিনি একটি দুর্ধর্ষ বাহিনীও তৈরী করেছিলেন। ইসলামের ইতিহাসের এই কিংবদন্তী যোদ্ধা কখনো অবরোধ দীর্ঘ হওয়ার পক্ষে ছিলেন না।
অবরোধের পর তিন কি চার দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। আন্তোনীস বন্দী মুজাহিদদেরকে রশি দিয়ে মজবুত করে বেঁধে কেল্লার প্রাচীরের নিকটে নিয়ে এসেছে। তারপর সাড়িবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ঘোষণা করল, অবরোধ তাড়াতাড়ি তুলে নাও, না হলে এদের ছিন্ন মস্তক তোমাদের উপহার দেয়া হবে।
একজন বন্দি মুজাহিদ বাঁধা অবস্থায় প্রাচীরের নিকটে দাঁড়িয়ে থেকেই অত্যন্ত উচ্চস্বরে বলল, মুজাহিদ ভাইয়েরা আমার! অবরোধ তুলে নিবে না। আমাদের নিহত হতে দাও। আমরা নিহত হওয়ার জন্যই আল্লাহর পথে বেরিয়েছি। আল্লাহ্ তোমাদের সহায়ক। কেল্লার প্রাচীর ভেঙ্গে ফেল!
বন্দী এই মুজাহিদের শাহাদাঁতের স্পৃহা ও মনের আবেগের উত্তাপে বাইরের মুজাহিদরা জ্বলে উঠল। তারা তখনই আক্রমণের জন্য চিৎকার শুরু করল। খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.) ও ইয়ায ইবনে গানাম (রা.) সেখানে উপস্থিত। তারা সবকিছুই উপলব্ধি করছিলেন। তারা মুজাহিদদের শান্ত থাকার আহ্বান জানালেন। বললেন, অযথা রক্তক্ষয় করে লাভ নেই। বুদ্ধিমত্তার সাথে অগ্রসর হতে হবে, ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে কাজ করতে হবে। সবাই আল্লাহ্র নুসরতের দুআ করতে থাক। আমরা ভাবছি।