ইবনে সামিরের কণ্ঠ এবার আবেগাপ্লুত হয়ে উঠল। বলল, তোমাদের আচার-আচরণে আমি এতো অভিভূত হয়েছি যে, আমার মনে চাচ্ছে, আমি আমার উদ্দেশের কথা তোমাদের নিকট বলে দেই। আমি একজন অত্যন্ত গোড়া প্রকৃতির খৃস্টান। খৃস্টধর্মের বিরুদ্ধে কোন কথা আমি সহ্য করতে পারি না। কিন্তু আমার ঐ নিহত দুই বন্ধু আমার বিশ্বাসে চির ধরিয়েছে। ওরা গোঁড়া খৃস্টান ছিল। আমাদের অন্তর দুই জাতির ঘৃণায় ছিল টইটুম্বর। রোমান জাতির ঘৃণা আর মুসলিম জাতির প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা। আমি একজন কিবতী খৃস্টান। আমাদের নেতা বিন ইয়ামিন।
মাসউদ বলল, তুমি মনে হয় ভুলে গেছো; জাহাজে তুমি আমাকে খৃস্টান মনে করে তোমার উদ্দেশ্যের কথা আমার নিকট ব্যক্ত করেছিলে। বলেছিলে, তুমি শামে যাচ্ছে। কিন্তু ঝড় তোমার উদ্দেশ্যকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। তুমি শামের খৃস্টানদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উৎসাহিত করতে যাচ্ছিলে।
ইবনে সামির বলল, হ্যাঁ আমি সে উদ্দেশ্যেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু এখন আর যাব না।
মাসউদ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন? কেন তুমি যাবে না? যদি তুমি মনে কর আসল কথা বললে আমরা তোমাকে হত্যা করব তাহলে তুমি ও তোমার স্ত্রীর এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাওয়া ভাল। আমরা মদীনায় যাচ্ছি। ঝড়ের কারণে আমরা উদ্দিষ্ট বন্দরে পৌঁছতে পারি নি। আর যদি চাও তাহলে আমাদের সাথে মদীনায় যেতে পার। সেখান থেকে আমরা তোমাকে শামের পথ দেখিয়ে দিব। আগে স্থির সিদ্ধান্ত নাও, আমাদের সাথে যবে কি-না?
আসলে ইবনে সামিরের মানসজগতে এক প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়েছে। তার চিন্তা চেতনা ও বিশ্বাসের দুনিয়া লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। সেখানে দেখা দিয়েছে বিধৌত বিমল আকীদা বিশ্বাসের আলোকময় সূর্য। যার আলোয় সে উদ্বাসিত। আর বিষয়টি বুঝতে পেরেছে মাসউদ ও তার সাথীদ্বয়। তাই তারা ইবনে সামির ও আইনীকে সাথে নিয়ে মদীনার পথে অগ্রসর হয়।
এভাবে তিন দিন তিন রাত চলার পর তারা মদীনায় গিয়ে পৌঁছল। ইতিমধ্যে ইবনে সামিরের সাথে মাসউদ অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে নিয়েছে। মিশরে রোমান সৈন্যদের অবস্থা সম্পর্কেও বহু দুর্লভ তথ্য জেনে নিয়েছে।
মাসউদ মদীনায় পৌঁছার পর ইবনে সামিরকে জিজ্ঞেস করল, বন্ধু! এখন কোথায় যাবে?
ইবনে সামির দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলল, আমি আমার গন্তব্য স্থানে পৌঁছে গেছি। আমি এ উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি যে, আমি ও আইনী মুসলমান হয়ে যাব।
মাসউদ কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল, আরো একটু ভেবে দেখ। আমরা তোমাদের উপর কোন চাপ প্রয়োগ করব না। যদি তোমরা ইসলাম গ্রহণ না কর তবুও আমরা তোমাদেরকে তোমাদের গন্তব্যস্থানে পৌঁছার ব্যবস্থা করব।
ইবনে সামিরের কণ্ঠ আবেগ বিজড়িত। বলল, ভাই মাসউদ! তোমাদের আচার-আচরণ, কথাবার্তা আর ইবাদত বন্দেগী দেখে আমার ভাবনা পাল্টে গেছে। আমি শুনেছি, ইসলাম আরবের অশিক্ষিত বর্বর লোকদের লাঞ্ছনা আর অপদস্ততার তলদেশ থেকে ইজ্জত ও মর্যাদার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। আমি তা যথার্থভাবে বুঝতে পারছি। আমার বিশ্বাস, যদি আইনী একা তোমাদের সাথে থাকে তাহলেও তোমরা তার সাথে এমন আচরন করবে না যা আমার স্বধর্মের ভাইয়েরা করেছে। সুতরাং আমি ও আইনী প্রতিজ্ঞা করেছি, আমরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিজেদের ধন্য করব।
মাসউদ ও তার সাথীদ্বয় ইবনে সামির ও আইনীকে তাদের সালারের নিকট নিয়ে গেল। ইবনে সামির তার জীবন বৃত্তান্ত সালারকে শুনাল এবং তারা মুসলমান হয়ে গেল।
ইবনে সামিরের দেয়া তথ্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো এ তথ্যগুলো আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর ফারুক (রা.)-এর নিকটও উপস্থাপিত হয়েছিল।