আন্তোনীস ও তার সাথীদের কাউকেই মুজাহিদরা চিনে না। লীজা ও ইউকেলিস তো সম্রাট পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। তাদের চিনার কোন প্রশ্নই আসে না। তবে ইউকেলিসকে কবিলাগুলোর প্রায় সকল সর্দারই চিনে। আর এ কারণেই সর্দাররা বিনা বাক্যব্যয়ে, নির্বিবাদে আন্তোনীসের পাশে এসে জড়ো হয়েছে।
ইউকেলিস কুস্তুনতীনের হাত থেকে এক আরব কবিলার সুন্দরী কন্যাকে উদ্ধার করেছিল। তাই তার সুনাম কবিলার সর্দারদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাছাড়া হিমসের যুদ্ধের পূর্বে প্রায়ই সে আরব কবিলাগুলোর যোদ্ধাদের মাঝে ঘোরাফেরা করত। সর্দারদের সাথে আলাপ আলোচনা করত। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের পুত্র হওয়ার কারণে সবাই তাকে সম্মান করত। আদর আপ্যায়ন করত। তার উদার মন-মানসিকতা ও প্রাঞ্জল কথাবার্তা মনোযোগ দিয়ে শুনত। তার বুদ্ধিমত্তা ও অনাড়ম্বর জীবন যাপনে সবাই বিস্মিত হত। তারা তাকে তাদের ইজ্জত ও আযাদী রক্ষার প্রহরী মনে করত। এবার তারা ইউকেলিসকে তাদের মাঝে পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত, বিমোহিত ও আশাবাদী হল।
***
রাতের আঁধার নেমে এলে মাঝে মধ্যে লীজা বাইরে বেরিয়ে আসে। কেল্লার প্রাচীর ধরে ঘুরে বেড়ায়। ইউকেলিস যুবক ছেলে। ঘরে সে বন্দী থাকতে পারে না। তাছাড়া তার তো বন্দী থাকার কোন প্রয়োজনই নেই। মুজাহিদদের কেউ তো তাকে চিনে না।
একদিন তার মন কেমন যেন উতলা হয়ে উঠল। কোন কিছুই তার ভাল লাগছে না। সবকিছুতেই তিক্ততা অনুভব করছে। মনের এই তিক্ততা ও অবসাদ দূর করার জন্য আলেপ্পা শহরের বাইরে উন্মুক্ত প্রান্তরে চলে গেল। উদ্দেশ্যহীনভাবেই ঘোরাফেরা করছে। শহরের বাইরের পৃথিবীটা যেন অন্য জগত। চারদিকে সবুজের সমারোহ। মাঝে মাঝে উঁচু উঁচু গাছপালা। দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের জমিন। এর মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে একটি সুন্দর খরস্রোতা নহর। নহরের নির্মল পানিতে প্রাণ জুড়ায়। নহরের কুল ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দূরে চলে এলো। নহরটি বাক কেটে এঁকে বেঁকে সরীসৃপের ন্যায় দূরে বহুদূরে চলে গেছে। ইউকেলিসের মনে এক অজানা প্রফুল্ল উঁকি দিল। গুণগুণ করে গান ধরে আনমনে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একটু দূরের ঝোঁপের আড়াল থেকে চারপাঁচ জন যুবতীর হাস্যধ্বনি শুনতে পেল। উৎকর্ণ হয়ে উঠল তার কান। দৃষ্টিতে তার চরম অনুসন্ধিৎসা। তারা দৌড়ে ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ইউকেলিসের সামনে পড়ে গেল। ইউকেলিসকে দেখেই তারা অপ্রস্তুত। হতবাক। তবে তাদের একজন ইউকেলিসকে দেখে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে ক্ষণকাল তাকিয়ে তার দিকে এগিয়ে এল। ইউকেলিস মেয়েটির আচরণে বিস্মিত হল।
মেয়েটি বলল, আপনি আমাকে চিনতে ভুললেও আমি কখনো আপনাকে ভুলব না। আপনিই আমার ইজ্জত রক্ষা করেছিলেন। আপনি না হলে………।
ইউকেলিস মৃদু মিষ্টি হাসির পরাগ ছড়িয়ে বলল, সে তো আমার দায়িত্ব ছিল। আমি কিন্তু তোমাকে চিনতে পারছিলাম না।
মরুর কোলে লালিত মেয়েটি যৌবনের কোঠায় পৌঁছলেও কৈশোরের দূরন্তপণা এখনো দূর হয়নি। অসম্ভব রূপবতী। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যৌবনের জৌলুস। রূপতরঙ্গের কলতান। লাবনী ঝরে পড়ছে আভরণ ভেদ করে। আর আভরণ বাড়িয়েছে তার রূপের মহিমা। নিখুঁত আবেগ আর উচ্ছ্বাসে মেয়েটি নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ইউকেলিসের হাত ধরে তাতে চুমু খেল, চোখে লাগাল। তারপর তার বাম হাতটি গভীর দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। ইউকেলিস বলল, জন্ম থেকেই আমার বাম হাতটি এমন নিষ্ক্রিয়। শক্তিহীন।
মেয়েটির চেহারায় বিষাদ বিষাদ ভাব ছড়িয়ে পড়ল। চোখের কোণে নির্মল অশ্রু টলটল করতে লাগল। বলল, আমি আপনাকে প্রায়ই স্বপ্নে দেখি। আমি যখন ভাবি আপনাকে জীবনে আর কখনো দেখতে পারব না, তখন আমার হৃদয়ে বিষাদের তরঙ্গ বয়ে যায়। আপনার মত আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব আমার নিকট আমার জীবনের চেয়ে বেশী প্রিয়।
ইউকেলিস বলল, সে আমার বড় ভাই ছিল। আমি তাকে হত্যার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বাম বাজু না থাকলেও আমি তলোয়ার, বর্শা ও কুঠার দিয়ে দুতিনজনের মোকাবেলা করে অনায়াশে পরাভূত করতে পারি।
মেয়েটির মধুর কণ্ঠস্বর শোনা গেল। বলল, শুনেছি আপনি নাকি সম্রাটের পুত্র। সে সম্রাট তো পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেছেন। তাহলে আপনি এলেন কোথা থেকে?
ইউকেলিস বলল, আমি সম্রাটকে ত্যাগ করে চলে এসেছি। সে দিন তোমার ইজ্জত রক্ষা করেছিলাম। আজ তোমাদের কবিলাগুলোর ইজ্জত রক্ষা করতে এসেছি। এখন থেকে আমি এখানেই থাকব।
মেয়েটির চেহারায় এক অভাবনীয় প্রফুলের প্রভা ছড়িয়ে পড়ল। সে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না যে, তার স্বপ্নের শাহজাদা তার সামনে উপস্থিত।
অন্যান্য মেয়ে অনতিদূরে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ভরা চোখে দেখছিল। মেয়েটি হাতে ইশারা করলে অন্যান্যরা কলহাস্যে চারদিক মুখরিত করে চলে গেল।
মেয়েগুলো চলে যাওয়ার পর ইউকেলিস ও মেয়েটি নহরের তীরে অবস্থিত একটি সুগন্ধি ফুলের ঝাড়ের পশ্চাতে গিয়ে বসল। তারা ঘেঁসে বসে আছে। মেয়েটি বার বার প্রশান্ত দৃষ্টি মেলে শিশুর সারল্য নিয়ে ইউকেলিসের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার দুরন্ত যৌবন যেন মুক্ত বিহঙ্গের মত পাখা মেলে উড়তে চাচ্ছে। ইউকেলিস আপাঙ্গে চেয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। মেয়েটির মসৃণ দীপ্তিময় মুখ তার চোখের পাতায় নেশা ধরিয়ে দেয়।