একথা শোনার সাথে সাথে ইবনে সামিরের চোখ ক্রোধে জ্বলন্ত কয়লার মত হয়ে গেল। অগ্নিঝরা কণ্ঠে বলল, এ পাপের শাস্তি হত্যা ছাড়া আর কি হতে পারে? এ কথা শুনার সাথে সাথে ইবনে সামিরের বন্ধুদ্বয় বিনয় বিগলিত কণ্ঠে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগল।
তিনজনে ধরে তাদের একজনকে মাটিতে চিৎ করে শুইয়ে দিল ও তার হাত পা বেধে দিল। মাসউদ তার খঞ্জরটি আইনীর হাতে দিয়ে বলল, এই খঞ্জরটি তার হৃদপিণ্ড বরাবর বসিয়ে দাও। তারপর তার পেট চিরে ফেল।
আইনী এমন ক্ষীপ্ত ছিল যা চিন্তা করা যায় না। সে খঞ্জরটি হাতে নিয়ে প্রথমে তার হৃদপিণ্ডে আঘাত করল। বিরামহীনভাবে আঘাত করতেই থাকল। যেন তার প্রতিশোধ স্পৃহা মিটছে না।
এভাবে দ্বিতীয় জনকেও আইনীর হাতেই হত্যা করাল। দু দুজনকে হত্যা করার পর আইনী ইবনে সামিরকে ঝাঁপটে ধরে দীর্ঘক্ষণ কাঁদল।
এরপর তারা উঁচু ভূমি টপকে খেজুর বাগানে নেমে দেখে, সেখানে স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে। তারা সেখান থেকে অঞ্জলি ভরে ভরে পানি পান করল। মাসউদের দুই সাথী গিয়ে খেজুর নিয়ে এলে তারা খেজুর খেয়ে জঠর জ্বালা নিবারণ করল।
***
ক্লান্ত সূর্য বিষণ্ণ বদনে অস্তমিত হওয়ার সকল আয়োজন শেষ করেছে। যাই যাই করে অস্তমিত হয়ে গেলেও তার আভা এখনো পশ্চিমাকাশ জুড়ে বিরাজ করছে। ক্ষুধা পিপাসায় দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার পর ক্লান্ত শ্রান্ত বদনে শীতল পানি পান ও খেজুর খাওয়ার পর সত্যই তাদের শরীর নেতিয়ে পড়ল। মাসউদ ইবনে সুহাইলের এক বন্ধু মাগরিবের আযান দিল। জামাতের সাথে তারা মাগরিবের নামায আদায় করল। ইবনে সামির ও আইনী নিষ্পলক নয়নে তাদের ইবাদতের বিস্ময়কর দৃশ্য দেখতে লাগল। এশার নামাযও তারা জামাতের সাথে আদায় করার পর একসাথে শুয়ে পড়ল।
ইবনে সামির ও আইনী তাদের নিকটে শুইতে চাইলে মাসউদ বলল, ভাই! তোমরা স্বামী স্ত্রী। তোমরা একটু দূরে গিয়ে শয়ন করো।
তারা একটু দূরে গিয়ে শোয়ার আয়োজন করল।
আইনী এমন ভয় পেয়েছে যে তার চোখে আর ঘুম আসছে না। ইবনে সামিরের অবস্থাও তাই। দীর্ঘক্ষণ তারা শুয়ে এপাশ ওপাশ করল। কিন্তু ঘুম এল না।
চারদিকে নিরব নিস্তব্ধ সুনসান। গোটা পৃথিবী যেন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। শুধু চোখ মেলে তাকিয়ে আছে ইবনে সামির ও আইনী। আইনী ফিফিসিয়ে ইবনে সামিরকে বলল, আপনি কি এ তিনজনকে বিশ্বাস করতে পারছেন?
ইবনে সামির বলল, এখনো আমি কিছু বলতে পারছি না। আমার বড়ই আক্ষেপ হয় যে, আমার নিকট কোন অস্ত্র ছিল না। একেবারে খালি হাতে সমুদ্র থেকে উঠে এসেছিলাম। যদি আবার তেমন কঠিন কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাহলে আমি তাদের থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করব।
আইনীর কণ্ঠ অত্যন্ত ভয়াতুর। বলল, আপনি কিন্তু ঘুমাবেন না। কিন্তু ধীরে ধীরে ঘুম ইবনে সামিরকে পরাজিত করতে যাচ্ছে। আর ইবনে সামির চাচ্ছে, কিছুতেই যেন ঘুম তাকে পরাজিত করতে না পারে। কারণ। আইনীর বয়স অল্প, অনিন্দ্য সুন্দরী। যদি তার স্বধর্মের লোকেরা আইনীকে নিয়ে এমন অপকর্ম করতে পারে তাহলে এদের ব্যাপারে ভরসা কি? এরা তো অন্য ধর্মের অনুসারী। এদের উপর কিভাবে ভরসা করতে পারি!
তারা উভয়ে বহু কষ্টে নিজেদের জাগ্রত রাখছে। অথচ মুসলমান তিনজন গভীর ঘুরে নিমজ্জিত। অর্ধরাত অতিক্রান্ত হওয়ার পর ইবনে সামির ও আইনী নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল এবং গভীর ঘুমে লুটিয়ে পড়ল।
হঠাৎ হাদের কানে এমন আওয়াজ পৌঁছল যেন কয়েকজন মানুষ লড়াই করছে। ডাক চিৎকার করছে। ইবনে সামির ও আইনী ভয়ে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠল। ভয়াতুর দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাতে লাগল। দেখল, মাসউদ ইবনে সুহাইল ও তার বন্ধুদ্বয় এখনো ঘুমে নিমজ্জিত। ইবনে সামিরের দৃষ্টি অন্য দিকে নিপতিত হলে দেখল, দূরে তার নিহত সাথীদের লাশ নিয়ে একদল মরু শৃগাল টানাটানি করছে আর মনের আনন্দে চিৎকার করে খাচ্ছে। তারা আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
আযানের আওয়াজ শুনে তাদের ঘুম ভেঙে গেল। দেখল, মাসউদের এক সাথী দাঁড়িয়ে উচ্চ কণ্ঠে আযান দিচ্ছে। আর মাসউদ ও অন্যজন ঝরণার পাশে বসে ওযু করছে।
ইবনে সামির আইনীকে বলল, আইনী ঘুমাও। এরা এখন নামায পড়বে। এরপর তারা আরো ঘুমাল। কিছুক্ষণ পর মাসউদ ইবনে সামিরকে জাগিয়ে বলল, যাত্রার সময় হয়ে গেছে। যদি আমাদের সাথে যেতে চাও তাহলে উঠ।
ইবনে সামিরের কণ্ঠে অভিমানের আভাস। বলল, আমি একা তো কোথাও যাব না। তোমাদের গন্তব্যস্থল পর্যন্ত তোমাদের সাথে যাব। তারপর সামনে অগ্রসর হব।
মাসউদ জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথায় যাবে?
ইবনে সামির থেমে গেল। কোন উত্তর দিল না। আইনীর দিকে আড় চোখে তাকাল। তারপর মাথা নত করল। আবার মাসউদের দিকে তাকাল। তার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে,সে কোথায় যাবে তার সঠিক উত্তর সে জানে না। মাসউদ তাকে পুনরায় একই প্রশ্ন করলে সে মাথা নত করে নিল।
মাসউদের এক সঙ্গী বলল, তাহলে কি তুমি কোথায় যাবে তা ভুলে গেছ?
ইবনে সামির উত্তরে বলল, না….আমার কোন গন্তব্য নেই। তবে আমার একটি উদ্দেশ্য আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
মাসউদের কণ্ঠ স্থির। বলল, আমরা তোমাকে বাধ্য করব না। যদি মনে কর আমাদের সাথে তোমার থাকার প্রয়োজন আছে তাহলে আমরা তোমাকে আমাদের সাথে থাকতে দিব। আর যদি প্রয়োজন না থাকে তাহলে এখানেই আমরা তোমাদের বিদায় জানাব।