তারা আমাকে মারতে মারতে বেহুশ করে মাটিতে ফেলে দিল। তারপরও তারা আমাকে মারল, যেন আমি আর উঠে দাঁড়াতে না পারি।
আমার যখন হুশ ফিরে আসল, মনে হল যেন আমার শরীরের অনেকগুলো হাড় ভেঙে গেছে। মাথা কেবল ঘুরছে। আমি উঠে দাঁড়াতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না। তখন সূর্য উদিত হয়ে গেছে। চারদিকে ঘুরে ফিরে তাকালাম। কাউকে দেখতে পেলাম না। চারদিকে শুধু বালি আর বালি। আমি বুঝে ফেললাম, তারা আইনীকে নিয়ে চলে গেছে। আমার জীবনের চারদিক এখন অন্ধকার হয়ে গেছে। জীবন যুদ্ধের ব্যর্থতার কথা বসে বসে চিন্তা করছিলাম আর ক্রমেই যেন অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। ঠিক এরই মাঝে তোমরা এসে আমাকে জাগালে।
ইবনে সামির বিষণ্ণ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলল, ভাই মাসউদ! আমি এ আশা রাখি না যে তোমরা আমাকে সাহায্য করবে। তবে তোমাদের একটি কথা আমার অন্তরে আশার সঞ্চার করেছে। তোমরা বলেছে, আমি তোমাদের দেশে পৌঁছেছি। তাই তোমরা আমাকে একা ফেলে যেতে পার না। তাহলে কি আমি আশা করতে পারি যে, তোমরা আমাকে সাহায্য করবে? মাসউদ ইবনে সুহাইল বলল, শোন ইবনে সামির! আমি একজন মুসলমান। আমি ইসলামের বিধি বিধান মেনে চলি। তোমার ধর্ম যাই হোক, কিন্তু তুমি একজন মানুষ। বিপদে আক্রান্ত। এ অবস্থায় আমার ধর্মের নির্দেশ, তোমাকে সহায়তা করা। আমরা অবশ্যই তোমার সহায়তা করব।
***
ইবনে সামির উঠে দাঁড়াল। মাসউদ ও তার বন্ধুরাও উঠে দাঁড়াল। তারা প্রথমে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে বালুকাময় ভূমির দিকে তাকাল। হ্যাঁ স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, এখানে মারামারি হয়েছে। ইবনে মাসউদ দেখল, বালুকাময় প্রান্তরে পায়ের ছাপ এক দিকে চলে গেছে। মাসউদ সে দিকে অগ্রসর হল। তার পিছু পিছু অন্যরাও অগ্রসর হল। মাসউদ অত্যন্ত বিচক্ষণ গুপ্তচর। মাঝে মাঝে পদচিহ্ন দেখে বুঝে ফেলল, আইনীকে তারা জোর করে নিয়ে গেছে। টেনে টেনে নিয়ে গেছে।
মাসউদ তার এক সঙ্গীকে বলল, মনে হচ্ছে তারা বেশী দূর যেতে পারেনি। আচ্ছা ইবনে সামির! তুমি কি বলতে পারবে, তাদের সাথে কি পান করার মত পানি আছে?
ইবনে সামির বলল, না, তাদের নিটক পানি থাকার কথা নয়। কারণ আমরা তো সমুদ্র থেকে মাত্র উঠে এসেছিলাম। ইবনে সামির হাঁটতে পারছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। মাসউদ ও তার এক সাথী ইবনে সামিরের হাত কাঁধে নিয়ে তাকে বয়ে চলছে।
ইবনে সামিরকে মাসউদ বলল, আমাদের গন্তব্য অন্যত্র হলেও আমরা প্রথমে তোমার স্ত্রী আইনীকে উদ্ধারের চেষ্টা করব।
সূর্যের আলো আরো একটু তীব্র হলে তার উত্তাপে ইবনে সামির কিছুটা সুস্থতা বোধ করতে লাগল। সে একজন সৈনিক। দেহ তার কষ্টসহিষ্ণু। জীবনে আরো কয়েকবার সে আহত অবস্থায় সফর করেছে, তাই সহজেই সে হাঁটতে পারছে।
পদচিহ্ন অনুসরণ করে তারা যথাসম্ভব দ্রুত চলতে লাগল। বেশ কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর দেখল, সেখানে যমীন কিছুটা শক্ত। আরো কিছুটা অগ্রসর হওয়ার পর নিম্নভূমি পেরিয়ে উঁচু ভূমিতে উঠল। পথের কোন চিহ্ন নেই। তবে পদচিহ্ন লক্ষ্য করে করে তারা এগিয়ে চলল। আরো কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর এক নিম্নভূমির দিকে তারা এগিয়ে গেল। বেশ দূর পর্যন্ত বিস্তৃত নিম্ন ভূমি অতিক্রম করে যখন তারা উচ্চ ভূমিতে উঠতে লাগল তখন মাসউদ আনন্দে চিৎকার করে উঠল। আল্লাহর দয়া দেখ। এখানে জান্নাত নেমে এসেছে যেন!
পিপাসায় তাদের হৃদয় শুকিয়ে গিয়েছিল। মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছিল না। তাই খেজুর বাগান দেখে আনন্দে তারা উদ্বেলিত হয়ে উঠল। খেজুর বাগান প্রায় দুমাইল দূরে অবস্থিত। তাদের বিশ্বাস, সেখানে পৌঁছতে পারলে পানিও পাওয়া যাবে। খাবারও মিলবে। এ আশায় তাদের শরীর বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠল। তারা দ্রুত হেঁটে চলল।
খেজুর বাগানের নিকট গিয়ে দেখে, বাগানের চারপাশ মাটি দেয়ালের ন্যায় উঁচু। এ প্রাকৃতিক দেয়াল টপকে ওপারে পৌঁছলেই তারা পাবে পানি আর টাটকা খেজুর। তারা খেজুর বাগানের নিকটে পৌঁছেই বাতাসের কোলে একটি মেয়েলী কণ্ঠের আর্তচিৎকার শুনতে পেল। সাথে সাথে তারা উৎকর্ণ হয়ে উঠল। আর্তচিত্তার লক্ষ্য করে তারা ছুটে গেল এবং সেই উঁচু ভূমিতে উঠতে লাগল। এবার সেই আর্তচিৎকার স্পষ্ট শুনতে পেল। তারা এবার তাদের দৃষ্টি সেদিকে নিবন্ধ করতেই দেখতে পেল, দুজন পুরুষ একজন নারীকে টেনে উঁচুতে তুলতে চেষ্টা করছে।
ইবনে সামির এ দৃশ্য দেখে বিহ্বল কণ্ঠে বলল, এই তো আমার আইনী!
মাসউদ ইবনে সুহাইল ও তার সাথীদ্বয় দৌড়ে গিয়ে সেখানে পৌঁছল এবং আইনীকে ধরে নিজেদের দখলে নিয়ে এল। ইবনে সামিরের বন্ধু দুজন ক্ষীপ্ত হয়ে বলল, এই মেয়ে তাদের। একে কেউ তাদের থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। ইবনে সামির ছুটে গিয়ে বলল, এ আমার স্ত্রী।
মাসউদ ও তার সাথীরা খঞ্জর বের করল। ইবনে সামিরে বন্ধুদ্বয়ের কাছে কোন অস্ত্র ছিল না। তারা অসহায়ের ন্যায় ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মাসউদ বলল, চুপ করে বসে থাক। একটু নড়বে তো সেখানেই শেষ হয়ে যাবে। তারা বসে থাকল। মাসউদ আইনীকে এনে সামনে দাঁড় করাল। বলল, হে মেয়ে! নির্ভয়ে বল, এরা তোমার সাথে কী আচরণ করেছে?
আইনী সবকিছু বলল, সবশেষে বলল যে, তারা তাকে এখানে এনে তার ইজ্জত হনন করেছে।