মুসলমান গুপ্তচর বলল, ইবনে সামির! আমি এখন তোমাকে আমার ব্যাপারে সঠিক তথ্য দিচ্ছি। আমি খৃস্টান নই। আমি মুসলমান। আমার নাম মাসউদ ইবনে সুহাইল মক্কী। তুমি এখন আমার দেশে এসে গেছে। আমি আর আমার এই বন্ধুরা তোমাকে এখানে একাকী রেখে যেতে পারি না। মাসউদ ইবনে সুহাইল ও তার দুই বন্ধু ইবনে সামিরের পাশে বসে পড়ল। মাসউদ বলল, এখন তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পার যা তুমি বলতে চাচ্ছো।
ইবনে সামিরের স্মৃতিতে বারবার এ কথা ভেসে উঠছে, সে তো তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। ভাগ্যের জোরে বেঁচে আছে। ঘোর বিপদের সময় সে যখন বন্ধু হিসাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে তখন দেখা যাক সে কি উপকার করে। এ কথা ভেবে সে তার নির্মম কাহিনীটি বলতে আরম্ভ করল।
কী আর বলব বন্ধু! জাহাজটি যখন ডুবতে ছিল তখন আমি আর আমার দু সঙ্গী সমুদ্রের বুকে ঝাঁপ দিলাম। আইনীর প্রতি আমার খেয়াল ছিল সবচেয়ে বেশী। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যদি আমার আইনী নিমজ্জিত হয় তাহলে আমিও তার সাথে নিমজ্জিত হয়ে পরপারে চলে যাব। আইনী ছাড়া এ জীবন আমার বৃথা, অর্থহীন।
আমি সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আইনী আইনী বলে চিৎকার করতে লাগলাম। আইনীও সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছিল। কিন্তু আমি তাকে খুঁজে পেলাম না। আইনীর সন্ধানে আমি পাগলের মত এদিক সেদিক সাঁতার কাটছি। হঠাৎ আমি দেখলাম, আমার এক সাথী আইনীকে তার পিঠে তুলে নিয়ে সাঁতরে উপকূলের দিকে যাচ্ছে। আর আমাকে বলছে, আইনীর ব্যাপারে চিন্তা করো না, চলে এস। তখন ছিল এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। যেন কিয়ামত। ঝড়ের তীব্র বেগ। মানুষের আর্তচিৎকার,নারীদের আহাজারি আর শিশুদের আর্তনাদে কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। তবুও আমি আমার বন্ধুর কথা শুনে নিশ্চিত হলাম। উপকূলের দিকে সাঁতার দিলাম। আমরা তিনজন যখন বহু কষ্টে সাঁতরে উপকূলের নিকট পৌঁছলাম তখন এক বিশাল ঢেউ এসে আমাদের একেবারে উপকূলে ফেলে নীচে নেমে গেল।
আমরা প্রাণে বেঁচে গেলেও শরীরের অবস্থা একেবারে কাহিল। ক্লান্তিতে দাঁড়াতে পারছিলাম না। বেশ কিছুক্ষণ মাটিতে পড়ে রইলাম। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু কোথায় যাব। কোন দিকে যাব কিছুই চিনি না। জাহাজের দুএকজন বেঁচে যাওয়া যাত্রী বলল, এটা আরব উপকূল। শাম এখান থেকে অনেক অনেক দূর।
আমরা অজানা উদ্দেশে রওনা দিলাম। বহু পথ অতিক্রম করার পরেও কোন জনমানবের চিহ্ন পেলাম না। ইতিমধ্যে রাত ঘনিয়ে এল। রাত কাটানো ও বিশ্রামের জন্য এক জায়গায় শোয়ার ইচ্ছে করলাম। আইনী আমার স্ত্রী। তাই আইনী ও আমি একটু দূরে একত্রে শুইলাম। ক্লান্ত অবসন্ন শরীর। শোয়ার সাথে সাথে গভীর ঘুমে হারিয়ে গেলাম।
রাত প্রায় অর্ধ। হঠাৎ চিৎকার আর কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। জ্যোৎস্না বিধৌত রজনী। বেশ দূর পর্যন্ত সবকিছু দেখা যায়। আমি দেখলাম, আইনী আমার পাশে নেই। দূরে, বেশ কিছুটা দূরে তাকিয়ে দেখলাম, আমার সাথী দুইজন আইনীর সাথে ধস্তাধস্তি করছে। যে সাথী আইনীকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করেছিল সে আইনীর উপরে চেপে বসতে চাচ্ছে আর অপর সাথী আইনীর হাত ধরে তাকে সহায়তা করছে।
আমি দৌড়ে সেখানে গেলাম। মাথায় যেন আগুন ধরে গেছে। প্রথমে এক বন্ধুকে ঘুসি মেরে মাটিতে ফেলে দিলাম। তারপর অন্য জনকে লাথি মেরে ফেলে দিলাম এবং আইনীকে হাত ধরে তুলে নিলাম। আমি ভাবতেই পারিনি, বন্ধু হয়ে কিভাবে বন্ধুর স্ত্রীর ইজ্জত নষ্ট করতে পারে! অথচ আমরা কতো পবিত্র মিশন নিয়ে এদেশে এসেছি।
রাতের নিরবতা ভেঙে এক বন্ধুর কণ্ঠ শোনা গেল, দূরে থাক হে ইবনে সামির! আমি তাকে সমুদ্র থেকে তুলে এনেছি। আর আমার এই বন্ধু আমাকে সহায়তা করেছে। তাই তার উপর আমাদের অধিকার আছে।
আরেকজনের কর্কশ কণ্ঠ শোনা গেল, বলল, তুমি তো তাকে ডুবে মরার জন্য সমুদ্রে ফেলে এসেছিলে। এখন তার উপর তোমার কি অধিকার আছে?
আমি আইনীকে পিছনে দাঁড় করালাম। ভাবলাম, এদের মাথায় শয়তান আশ্রয় নিয়েছে। এরা তাদের পবিত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশের কথা ভুলে গেছে। তাই আমাদের লক্ষ্য উদ্দেশের কথা বলে, খৃস্টধর্মের দোহাই দিয়ে এ পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে তাদের অনুরোধ করলাম। কিন্তু কোন প্রচেষ্টাই ফলপ্রসূ হল না। তারপর তাদের ধমক দিলাম। শাসালাম। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হল না। তারা তাদের দাবীতে অটল।
সবশেষে এক বন্ধু প্রস্তাব দিল, বলল, অন্তত আজ রাতের জন্য তুমি আইনীকে আমাদের হাতে সোপর্দ করো। আমি তাতেও রাজী হলাম না। কারণ আইনী আমার স্ত্রী। জীবন থাকতে আমি তার ইজ্জতহানী সহ্য করতে পারি।
আমি তাদের কথাবার্তায় অত্যন্ত ক্ষীপ্ত হয়ে উঠলাম। বললাম, তোমাদের উপর শয়তান ভর করেছে। আর শয়তানকে কিভাবে তাড়াতে হয় তার পন্থা আমার বেশ ভাল করে জানা আছে।
এ কথা বলে তাদের দিকে অগ্রসর হলাম। তারাও আর দেরি করল না। আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমাদের কারো নিকট কোন অস্ত্র ছিল না। থাকলে তখনই কেউ না কেউ নিহত হয়ে যেত। উভয়জন আমাকে মুষ্ঠাঘাত, পদাঘাত করতে লাগল। আমিও সাহসিকতার সাথে প্রতিহত করতে থাকলাম। কিন্তু তারা ছিল শক্তিশালী যুবক। তারা আমাকে ক্রমেই মেরে যাচ্ছে। আইনী অবলা নারী। অল্প তার বয়স, সে আমাকে কিভাবে উপকার করবে। অদূরে দাঁড়িয়ে সে শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ জানাচ্ছে।