ইবনে সামির মুসলমান গুপ্তচরটির হাত ধরে জাহাজের ছাদের উপর হাঁটছে। তারা জ্যোৎস্নার অপরূপ ধারা দেখছে। তারা জাহাজের একেবারে কিনারায় এসে দাঁড়াল। ইতিমধ্যে চাঁদ মেঘের আড়ালে মুখ লুকাল। ফলে চারদিক আবছা অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। ইবনে সামিরের উভয় বন্ধু ঠিক তখনই ছাদের উপর উঠে মুসলমান গুপ্তচরটির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।
এ সময় জাহাজের ছাদে আর কেউ নেই। তাছাড়া মেঘমালাও তাদের সাহায্য করছে। জ্যোত্সলোকিত রাতকে হঠাৎ অন্ধকার করে দিয়ে তাদের সহায়তায় যেন এগিয়ে এসেছে। ঠিক তখন ঠাণ্ডা বায়ুর ঝাঁপটায় জাহাজটি দুলে উঠল। তিনজনই প্রস্তুত, এখনই মুসলমান গুপ্তচরকে অনন্ত পানির বুকে ফেলে দিবে। ঠিক তখন পশ্চাৎ দিক থেকে উচ্চ কণ্ঠে আওয়াজ এল, ভাইয়েরা! দ্রুত নিচে নেমে আসুন। ঝড় ধেয়ে আসছে। কেউ জাহাজের ছাদে থাকবেন না। তারা পশ্চাতে ফিরে দেখল, জাহাজের দুতিনজন মাল্লা তাদের দিকে ছুটে আসছে। তাদেরকে দ্রুত নিচে যাওয়ার জন্য তাড়া করছে। আর নিজেরা পালের দড়ি ঠিকঠাক করছে।
সাথে সাথে বাতাস তীব্র আকার ধারণ করল। দৈত্যের মত শিষ দিতে দিতে এগিয়ে আসতে লাগল বাতাস। তারপরই শুরু হল মুষল ধারায় বৃষ্টি। ঝর ঝর করে অবিরাম ধারায় বৃষ্টি পড়তে লাগল। সাথে বইছে ঝঞ্জা বায়ু। বিরাট জাহাজটি কাগজের নৌকার মত সমুদ্রের বুকে হেলে দুলে চলছে। আর পর্বতমালার ন্যায় উঁচু উঁচু তরঙ্গমালা সমুদ্রের বুকে আছড়ে পড়ছে।
জাহাজের যাত্রীদের ঘুম ভেঙে গেছে। একে অপরের গায়ে ছিটকে পড়ছে। শিশু আর মহিলারা চিৎকার করে কাঁদছে। ভয়ে সবাই সন্ত্রস্ত। সবার চেহারা ফ্যাকাসে রক্তশূন্য। ইবনে সামির আর তার বন্ধুরা নীল নক্সা ফেলে কোথায় গেল তার খবর নেই। সমুদ্রের বিশাল বিশাল তরঙ্গ ঝাঁপটায় জাহাজে পানি ঢুকছে।
জাহাজের পাল খুলে মাস্তুলের সাথে পেচিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তড়িঘড়ি করার কারণে ভালভাবে আটকানো হয়নি। তার কিছু অংশ খুলে বাতাসের ঝাঁপটায় বিকট আওয়াজ করতে লাগল। জাহাজটি এক প্রচণ্ড ঝড়ের মুখে পড়ল। কেউ কারো দিকে খেয়াল রাখতে পারছে না। মায়েরা শিশু বাচ্চাদের বুকে চেপে ধরে রেখেছে। ঢেউয়ের তালে তালে যখন জাহাজটি উপরে উঠছে তারপর আছড়ে পড়ছে তখন শিশু বাচ্চাদের বুকের সাথে জড়িয়ে রাখাও কষ্টকর হচ্ছে। জাহাজের ভিতর প্রচুর পানি প্রবেশ করে সব ভিজে গেছে।
যাত্রীরা সবাই চিৎকার করছে। ডাকাডাকি করছে। কিন্তু ঝড়ের প্রচণ্ডতায় তা শোনা যাচ্ছে না। জাহাজটি এখন মাঝি মাল্লাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। জাহাজকে আর সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ঝড়ের ঝাঁপটায় জাহাজটি উপকূলের অনেক নিকটে চলে এসেছে। প্রচুর পানি উঠার কারণে তা ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ নিরাশ হয়ে পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছে এবং উপকূলের দিকে সাঁতরে যাচ্ছে। এরপরই এক প্রবল ঝাঁপটায় জাহাজটি কাত হয়ে ডুবে গেল।
***
সকালের প্রশান্ত আকাশে ডানা মেলে উড়ে উড়ে যাচ্ছে খণ্ড খণ্ড মেঘ। এ শান্ত পরিবেশ দেখে বুঝা যাবে না, রাতে কী তাণ্ডব লীলা বয়ে গেছে সমুদ্রের বুক জুড়ে। অথচ এখন সমুদ্রের বুক একেবারে শান্ত সমাহিত।
উপকূলের দূরে দূরে এদিকে সেদিকে কিছু কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে আছে। কেউ কেউ পা টেনে টেনে হাঁটছে। এরা ভাগ্যবান। সাঁতার কেটে কোনক্রমে উপকূলে এসে জীবন বাঁচিয়েছে। যারা সাঁতার জানে না তাদের এই সমুদ্রের বুকে সলিল সমাধি রচিত হয়েছে।
জাহাজ নিমজ্জিত হওয়ার পরের দিনের ঘটনা। তিনজন লোক ধীরে ধীরে সমুদ্র উপকূলের বহুদূর থেকে হেঁটে যাচ্ছে। দেখলেই বুঝা যায় এরা আরব। তাদের জানা আছে, সন্ধ্যার আগেই তারা এক জনবসতিতে পৌঁছে যাবে। এ এলাকা তাদের নখদর্পণে। তারা জিদ্দা ও মদীনার মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে যাচ্ছে। তাদের দেখলেই বুঝা যায়, তারা বিধ্বস্ত, তারা সমুদ্রের ঝড়ের কবলে পড়েছিল। কোন রকম সাঁতরে উপকূলে উঠতে সক্ষম হয়েছে।
প্রায় আড়াই তিন মাইল অতিক্রম করার পর তারা দেখল, এক ব্যক্তি বসে আছে। মনে হয়, বসে বসে ঝিমাচ্ছে। এরা তিনজন সেই লোকটির নিকট গেল। লোকটি এবার মুখ তুলে তাকাল। ডাগর দৃষ্টি মেলে তাদের দেখতে লাগল। একজনকে চিনে ফেলল। সে ঐ মুসলমান গুপ্তচর যাকে ইবনে সামির ও তার বন্ধুরা জাহাজের ছাদ থেকে সমুদ্রে ফেলে হত্যা করতে চেয়েছিল।
মুসলমান গুপ্তচরও তাকে চিনে ফেলল যে, সে ইবনে সামির। বলল, ইবনে সামির! তুমি খুব ভাগ্যবান। এ প্রচণ্ড ঝড়ের মাঝে সমুদ্রের বুক চিরে উপকূলে পৌঁছতে পারা বড়ই ভাগ্যের ব্যাপার। আচ্ছা, তোমাদের সাথে যে সুন্দরী যুবতীটি ছিল তাকে তো দেখছি না। তাহলে কি সে ডুবে গেছে?
ইবনে সামিরের কণ্ঠ বিষণ্ণ। বলল, না বন্ধু; সে আমার স্ত্রী। সে সমুদ্রে ডুবে যায়নি। এ মরুভূমিতে ডুবে গেছে।
মুসলমান গুপ্তচর বলল, ইবনে সামির! তোমার দুঃখের কথা আমি বুঝতে পেরেছি। সে সমুদ্র থেকে তো মুক্তি পেয়েছে কিন্তু বেঁচে থাকতে পারেনি। মৃত্যুবরণ করেছে। আর তুমি তাকে মরুর বুকে দাফন করে দিয়েছো!
ইবনে সামিরের কণ্ঠ আরো বেশী ভারাক্রান্ত ও বিষণ্ণ শোনা গেল। বলল, বন্ধু! তুমি আমার কথা কিছুই বোঝ নি। আমার জীবনের উপর দিয়ে যে কি নির্মম ঝঞ্ছা বয়ে গেছে তাকি আমি তোমাকে বলব?