ইবনে সামির তখন হাসতে হাসতে বলল, আমরা এ বার্তা নিয়েই শামে যাচ্ছি। গোপনে আমরা এ কাজটাই করতে চাচ্ছি।
খৃস্টান লোকটি কথার ছলে তাদের থেকে সম্রাট হিরাক্লিয়ার্স, বিন ইয়ামিন ও মুকাওকিসের কি পরিকল্পনা তাও জেনে নিল। লোকটি তাদের থেকে এ কথাও জেনে নিল যে, বর্তমানে রোমান সৈন্যদের অবস্থা কেমন? রোমান জেনারেলরাই বা কি চিন্তা করছে? ইবনে সামির নিজেও সৈনিক, তাছাড়া বিন ইয়ামিনের নিকট গিয়ে সে আরো অনেক কিছু জানতে পেরেছে। সে এসব কিছুই লোকটিকে বলেছে।
এক রাতে ইবনে সামির জাহাজের উপরে একেবারে ছাদে গেল, ছিল জ্যোৎস্না বিধৌত রজনী। আকাশে হাল্কা মেঘের ফাঁক গলে যেন গলিত চাঁদির ধারা সমুদ্রের বুকে পড়ছে। তরঙ্গমালা যেন মাথায় ঝিকমিকি তাজের মুকুট নিয়ে ছুটে চলছে। ইবনে সামির বিমোহিত হৃদয়ে চারদিক অবলোকন করছে।
হঠাৎ তার দৃষ্টি এক ব্যক্তির উপর পড়ল। জাহাজের ছাদের এক প্রান্তে। মনে হল লোকটি সেই মধ্যবয়সী খৃস্টান। আবছা অন্ধকারে তার সন্দেহ হল। অন্য লোকও হতে পারে। ইবনে সামির আরো একটু এগিয়ে গেল। বিস্ময়ে তার চোখ একেবারে ছানাবড়া। আরে সে তো সেই মধ্যবয়সী লোকটি। তবে তার বিস্ময়ের কারণ কিন্তু অন্য কিছু। সে দেখল, সেই লোকটি সেখানে নামায পড়ছে। আরো দুজন লোকও তার অদূরে দাঁড়িয়ে নামায পড়ছে।
নামায শেষ হলে ইবনে সামির তার আরো নিকটে গেল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, তুমি বলেছিলে, তুমি মুসলমান নও। কিন্তু এখন দেখছি তুমি নামায পড়ছো?
খৃস্টান লোকটি বলল, ভাই আমি দরবেশ মানুষ। আল্লাহর ইবাদত করা দরকার, তাই তার ইবাদত করি। আমি মুসলমানদের নামায পড়ছি না; বরং আমি এভাবে আল্লাহকে স্মরণ করছি।
এ উত্তর শুনে ইবনে সামির সন্তুষ্ট হতে পারল না। আরো বেশ কিছু প্রশ্ন তাকে করল আর সে প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করল। এরপর ইবনে সামির চলে এল। তবে তার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না যে সে একজন খৃস্টান। তার নিশ্চিত বিশ্বাস হয়ে গেছে যে সে মুসলমান। সে তার বন্ধুদ্বয়ের নিকট গিয়ে সবকিছু বলল। তারপর অভিমত প্রকাশ করে বলল, এ ধরনের লোকেরা গুপ্তচর হয়। আমার মনে হয়, সে মুসলমানদের গুপ্তচর।
পরদিন ইবনে সামির অন্যান্য মুসলমান যাত্রীদের সাথে আলোচনা করে জেনে নিল যে, সে মুসলমান। একজন আরব। তবে কেউ বলতে পারেনি, সে কি গুপ্তচর না সাধারণ নাগরিক।
একথা জানার পর ইবনে সামির দারুন ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল। কারণ লোকটি খৃস্টানের বেশ ধরে তার থেকে অনেক গোপন কথা জেনে নিয়েছে যা সে কারো নিকট বলত না। এরপর ইবনে সামির তার বন্ধুদ্বয়ের নিকট বলল, এই খৃস্টানভেশী লোকটি আমার থেকে অনেক গোপন কথা জেনে নিয়েছে। তাকে কিছুতেই ক্ষমা করা যায় না। বন্ধুদ্বয়ের মাথায়ও ছিল উন্মাদনা। তারা সিদ্ধান্ত নিল, হাত পা বেধে তাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে হবে।
ইবনে সামির বলল, দেরি করা ঠিক হবে না। আজ রাতেই তা করতে হবে। তার সাথে আমার বেশ আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়েছে। আমি তাকে বলল, চল বন্ধু জাহাজের ছাদে গিয়ে বসি। তারপর তাকে ছাদের এমন এক জায়গায় নিয়ে যাব যেখানে কেউ যায় না। সেখান থেকেই তাকে সমুদ্রে ফেলে দিব।
বিকালে ইবনে সামির সেই মুসলমান গুপ্তচরের নিকট গেল। গভীর আন্তরিকতার সাথে কথাবার্তা বলল। তারপর বিনীত কণ্ঠে বলল, বন্ধু! আজ আমি তোমার সাথে রাতে নির্জনে কিছু কথা বলতে চাচ্ছি।
মুসলমান গুপ্তচর বলল, কোন বিশেষ কথা আছে, না এমনি গল্পগুজব করবে?
ইবনে সামির বলল, ভাই! আমি অনেক চিন্তা ভাবনা করেছি। অবশেষে তোমার কথাই মানতে বাধ্য হয়েছি যে, তুমি সত্যই একজন দরবেশ মানুষ। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য তুমি কত ইবাদত করছ। তুমি অত্যন্ত জ্ঞানী। আমি তোমার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে চাচ্ছি। আজ রাতে তুমি আমাকে সে পথের সন্ধান দিবে। আসলে আমি এক পেরেশান ও অস্থির চিত্তের মানুষ। কোথাও শান্তি পাই না। মনে হয় আল্লাহ্ আমার প্রতি নারাজ। আমি তোমাকে আমার জীবন কাহিনী শুনাতে চাই।
মুসলমান গুপ্তচর বলল, তুমি যখন বলবে তখনই আমি এসে উপস্থিত হব। তুমি চাইলে আমি সারারাত জেগে তোমার জীবন কাহিনী শুনব।
ইবনে সামির বলল, যখন জাহাজের যাত্রীরা সবাই ঘুমিয়ে পড়বে তখন তুমি ছাদে চলে আসবে। মুসলমান গুপ্তচর তা মেনে নিল।
ইবনে সামিরের অন্তর এবার মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় আনন্দে দুলছে। ছুটে গেল বন্ধুদ্বয়ের নিকট। বলল, আজ রাতে শিকার নিজেই নিজের জালে আটকা পড়বে। একথা শুনে বন্ধুদ্বয় খুব আনন্দিত হল। মুসলমান গুপ্তচরকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করার সব পরিকল্পনা পাকা করে নিল।
***
সে দিন জাহাজটি প্রায় অর্ধপথ অতিক্রম করে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। রাতে নির্ধারিত সময়ে মুসলমান গুপ্তচরটি জাহাজের ছাদে চলে গেল। এর কিছুক্ষণ পরই ইবনে সামির তার নিকট এল। জাহাজের যাত্রীরা সবাই শুয়ে আছে। ছাদে দুতিন জন মানুষ বসে আছে। তারা রাতের জ্যোৎস্নার অপরূপ দৃশ্য উপভোগ। করছে। আকাশে তখন থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আকাশের দিগন্ত থেকে মেঘমালারা যেন বিক্ষোভ করতে করতে ছুটে আসছে। সমুদ্রের বুকে বাতাস একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। থমথমে অবস্থা। জাহাজের বিরাট পাল যা বাতাসের ঝাঁপটায় ফুলে ছিল তা চুপসে গেছে। ফলে জাহাজও তার গতি হারিয়ে ধীরে ধীরে চলছে।