চলার পথে তারা জনবসতি ও সৈন্যদের চৌকি থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। ইবনে সামিরকে নিয়েই ভয়। কারণ সে পলাতক সৈন্য। যে কোন সময় রোমান সৈন্যদের হাতে গ্রেপ্তার হতে পারে। ইবনে সামির অবশ্য তার বেশভূষা ও আকার আকৃতি পাল্টে নিয়েছে। ঘন চাপ দাড়িতে তাকে এখন চেনাই মুশলিক। আর তার গায়ে এখন পাদ্রীদের লম্বা আলখেল্লা। দেখলে এখন কোনভাবেই বুঝা যায় না যে, সে সেই দুর্ধর্ষ রোমান সৈনিক।
ইবনে সামির সৈনিক জীবনে মিশরের অনেক জায়গায় ঘুরেছে। অনেক মানুষের সাথে মিশেছে। মিশরের সকল সেনানিবাসেই তার পরিচিত লোকজন আছে। তাদের থেকে দূরে থাকা এখন খুবই জরুরী। মিশরের বন্দরগুলো তার নখদর্পণে। সে জানে, মিশরের পূর্বপ্রান্তে লোহিত সাগরের তীরে এবং আরো একটু সামনে দুটি বন্দর রয়েছে। কিন্তু এ বন্দর দুটিতে যাওয়া যাবে না। কারণ সেখানে সর্বদা রোমান সৈন্যরা প্রহরা দেয়। এছাড়া লোহিত সাগরের তীরে এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে ছোট খাট জাহাজ নোঙ্গর করে। রোমান সৈন্যরা সেখানে প্রহরা দেয় না।
তিন দিন তিন রাত পর তারা এক বন্দরে পৌঁছল। এখানে ছোট পালতোলা জাহাজ পাওয়া যাবে। বন্দরটি নিরাপদ। রোমান সৈন্যদের প্রহরা সেখানে নেই। বন্দরে পৌঁছে তারা জানতে পারল, তিন চারদিন পর একটি জাহাজ বন্দর ছেড়ে যাবে। জাহাজটি বেশ বড়। তারা তাদের ঘোড়াও সাথে করে নিয়ে যেতে পারবে। তারা বন্দরেই বিশ্রাম করল। চতুর্থদিন তারা জাহাজে আরোহণ করল। তাদের পরিকল্পনা, আরবের কোন উপকূলে পৌঁছতে পারলেই তারা সেখান থেকে সহজে শামে পৌঁছতে পারবে।
***
যদি জাহাজটি সোজাসুজি আরব উপকূলের দিকে যেত তাহলে তার দূরত্ব হত প্রায় একশত মাইল। কিন্তু জাহাজটি আরব উপকূলের এক দূরবর্তী বন্দরে যাচ্ছে তাই প্রায় সাড়ে তিনশত মাইল নদীপথ অতিক্রম করতে হবে। এতে কয়েকদিন লেগে যাবে।
জাহাজ নোঙ্গর তুলে পাল উড়িয়ে দিল। তর তর করে সামনে চলতে লাগল। পিছনে পড়ে রইল উপকূলের ছোট ছোট ঘর আর দোকানগুলো। বাতাসের ঝাঁপটায় কম্পমান গাছের ডালপালাগুলো যেন হাত নেড়ে নেড়ে তাদের চির বিদায় জানাচ্ছে। তরঙ্গ মালার বুক চিরে জাহাজটি বেশ দূর এগিয়ে গেলে ইবনে সামির তার দুই বন্ধুকে বলল, জাহাজের আরোহীদের সাথে কথাবার্তা আর আলাপ-আলোচনা করে যাদের খৃস্টান পাওয়া যায় তাদেরকে আমাদের এই মিশনের সঙ্গী বানানোর প্রচেষ্টা করতে হবে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হল। দুদিনে তারা জেনে নিল জাহাজে কতজন খৃস্টান আছে আর কতজন মুসলমান আছে।
ইতিমধ্যে ইবনে সামির জেনে নিয়েছে যে, জাহাজটি তাদেরকে আরব উপকূলের কোন এক বন্দরে নামিয়ে দিবে। সেখান থেকে শাম অনেক অনেক দূর। এ দীর্ঘ পথে রয়েছে মরুভূমি আর মরুভূমি। খৃস্টধর্মের নামে এ দীর্ঘ সফরের কষ্টের জন্য সে নিজেও মানসিকভাবে প্রস্তুত হল। সাথীদেরও প্রস্তুত করে নিল। তা ছাড়া তাদের সাথে ঘোড়া রয়েছে। তাই তারা তেমন পেরেশান হল না।
এ কয়েকদিনের প্রচেষ্টায় তারা জাহাজে তাদের সমমনা চার-পাঁচজন নেতৃস্থানীয় খৃস্টান পেল। তাদের একজন শামের এক গোত্রের সর্দার। তিন বন্ধু মিলে তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কাতে লাগল। আলোচনা পর্যালোচনাও হল বেশ। অবশেষে তারা তাদের মতামত মেনে নিতে বাধ্য হল। ইবনে সামির ও তার বন্ধুরা তাদের এ কথা জানাল, তারা এখন শামে যাচ্ছে। সেখানে খৃস্টান গোত্রগুলোকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উৎসাহিত ও উদ্বেলিত করবে। প্রয়োজনে তারা খৃস্টধর্মের প্রচার প্রসার ও রক্ষার জন্য জীবন উৎসর্গ করবে।
তারা আরেকজন মধ্যবয়সী খৃস্টানকে পেল। দারুন সতর্ক। তার কথা বলার ভঙ্গীই অন্য ধরনের। কারো সাথে কথা বললে শ্রোতা অবশ্যই তার কথায় প্রভাবিত হয়ে পড়ে এবং তার মতামত মেনে নিতে বাধ্য হয়।
ইবনে সামির ও তার সাথীরা এ মধ্যবয়সী খৃস্টানকে তাদের দলে ভীড়ানোর পরিকল্পনা করল। একদিন তিনজনই তার নিকট এল। কথাবার্তা শুরু করল। ইবনে সামির জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় থাকেন?
লোকটি বলল, আমি শামের অমুক শহরে থাকি। এবার তাদের টনক নড়ে উঠল। ভাবল, তাহলে তো ভালই হবে; সাথে তাকে নিতে পারলে বেশ জমবে। তারা তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক আলোচনা করতে লাগল। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের আলোচনা, মুসলমানদের আলোচনা, মিশরের অবস্থা ইত্যাদি আলোচনার পর এবার আসল কথা শুরু হল। তাহল বর্তমান প্রেক্ষাপটে খৃস্টধর্মের অনুসারীদের কি করতে হবে। কিভাবে মুসলমানদের এই আগ্রাসন থেকে তারা স্বধর্ম নিয়ে স্বকীয়তা বজায় রেখে বেঁচে থাকতে পারবে?
কথার মাঝে ইবনে সামির বলল, কে কি করল বা না করল তা এখন আমরা ভাবতে পারি না। বরং খৃস্টধর্মের অনুসারীদের এখন একতাবদ্ধ হয়ে খৃস্টরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে হবে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সর্বত্র বিদ্রোহ করতে হবে।
ইবনে সামির আরো একটু অগ্রসর হয়ে বলল, এখন যদি শামের খৃস্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাহলে কমপক্ষে তাদের ঐ অঞ্চলে খৃস্টরাজ্য তো প্রতিষ্ঠিত হবে।
মধ্য বয়সী খৃস্টান লোকটি ইবনে সামিরের কথা জোড়ালভাবে সমর্থন করল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল, আচ্ছা তা বাস্তবায়নের উপায় কি হতে পারে?