শামের অধিবাসীদের অধিকাংশই খৃস্টান। এরা বিদ্রোহ করলে অবস্থা কোন দিকে মোড় নেয় তা বলা মুশকিল। কারণ এরা যোদ্ধা জাতি। তবে ইতিপূর্বে একবার বিদ্রোহ করে সফল হতে পারেনি। মুসলিম বাহিনী কঠোর হাতে তাদের দমন করেছে। তবুও শামে এ ধরনের বিদ্রোহের আশংকা এখনো রয়েছে।
ঐতিহাসিকরা বলেছে, যদি মহামারী চলাকালে সম্রাট হিরাক্লিয়াস শাম আক্রমণ করে বসত তাহলে মুসলিম বাহিনী এক ভীষণ সংকটে নিপতিত হত। কারণ ইতিমধ্যে বহু মুসলিম মুজাহিদ মহামারীতে ইন্তেকাল করেছেন। কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় সেনাপতিও ইন্তেকাল করেছেন। হিরাক্লিয়াস আক্রমণ করলে হয়তো ইতিহাসের ধারা অন্য পথে যাত্রা করত। কিন্তু মহাপাদ্রী কীরাসের পরামর্শে তা হয়নি। সম্রাট আক্রমণ করার পরিকল্পনা স্থগিত করে দিয়েছিলেন।
***
ইতিমধ্যে বিন ইয়ামিনের নিকট আরো কয়েকজন গোঁড়া খৃস্টান এসেছে। এরা সবাই তার গুপ্তচর। তাদের দুএকজন ইবনে সামেয়ের মত পালাতক সৈন্য। এদের দুজনের সাথে ইবনে সামেবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। খৃস্টান ধর্মে গোড়া প্রকৃতির এই তিন বন্ধুর মাঝে অনেক গোপন আলোচনা হল। এরা তিনজনই মুসলমানদের ও রোমানদের ঘোর বিরোধী।
একদিন পড়ন্ত বিকেলের সোনালী আভায় যখন প্রকৃতি মোহময়, চারদিকে বইছে মৃদুমন্দ শীতল বায়ু তখন তিন বন্ধু এক গাছের নিচে গিয়ে বসল। জীবনের ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে আলোচনা করছিল। শামের কথা, মুসলমানদের উত্থানের কথা, নানা যুদ্ধের কথা, রোমান সৈন্যদের ভীরুতার কথা, সম্রাট পরিবারের কথা ইত্যাদি ইত্যাদি।
কথা প্রসঙ্গে এক বন্ধু বলল, তোমাদের কি মনে হয়, শামের খৃস্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে?
অপর বন্ধু বলল, না, বিন ইয়ামিন এ ধরনের বিদ্রোহের পক্ষে নয়, তার কথা হল, এ ধরনের বিদ্রোহ ইতিপূর্বে হয়েছে। কিন্তু নির্মমভাবে তা ব্যর্থ হয়েছে। আর সম্রাট হিরাক্লিয়াসের মহাপাদ্রী কীরাসও তাই বলে। সেও এ ধরনের বিদ্রোহ অপছন্দ করে।
ইবনে সামির বলল, তাহলে কি সম্রাট হিরাক্লিয়াস শাম আক্রমণ করেছেন না!
অপর বন্ধু বলল, না, তা আর হচ্ছে না। সম্রাট হিরাক্লিয়াস দোটানা অবস্থায় আছেন। কি করবেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
ইবনে সামির বলল, আমার মনে হচ্ছে, এরা মুসলমানদের সুযোগ দিচ্ছে যা খৃস্টধর্মের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটাই আক্রমণের সুবর্ণ সুযোগ, মোক্ষম সময়। এ সুযোগকে কাজে না লাগালে মুসলমানরা আবার শক্তি সঞ্জয় করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিবে। তারপরই মিশর আক্রমণ করবে।
এক বন্ধু বলল, বিন ইয়ামিনের চিন্তাধারা অত্যন্ত বিস্ময়কর। সে ভাবছে, শামে কোন প্রকার বিদ্রোহের প্রয়োজন নেই। মুসলমানরা মহামারী থেকে মুক্তি পেয়ে শক্তি সঞ্চয় করে মিশর আক্রমণ করে রোমানদের তাড়িয়ে দিক। তারপর সে মিশর দখলের ব্যবস্থা করবে।
আরেক বন্ধু অত্যন্ত উদ্বেলিত কণ্ঠে বলল, না না, তা হতে দিব না। তাহলে কি সে চায় যে শামের ন্যায় মিশরও মুসলমানরা পদানত করুক। এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। প্রয়োজনে আমরা শামে বিদ্রোহ করাব। কি বন্ধুরা! তোমরা কি এতে একমত?
তারা একটা পরিকল্পনা তৈরী করল। ভাবল, শামের খৃস্টানদের বিদ্রোহে উৎসাহিত ও উদ্বেলিত করার জন্য এখান থেকে কিছু লোক শামে পাঠানো দরকার। তারা শামে গিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এ কাজ সম্পাদন করবে। কিন্তু কাদেরকে তারা পাঠাবে। তাদের অনুগত তো কেউ নেই। বরং তারাই তো বিন ইয়ামিনের অনুগত গুপ্তচর।
একজন বলল, বন্ধুদ্বয়! আমরাই তো এ কাজ সম্পাদনে এগিয়ে যেতে পারি। এ গুরুতর কাজ অন্যের দ্বারা কতটুকু হতে পারে! আমরা তিন বন্ধু তো আছি আর আমাদের সাথে থাকবে আইনী। জীবনের সকল সঞ্চিত অভিজ্ঞতা দিয়ে যদি সফল হতে পারি তাহলে খোদাবন্দ ইসা মসীহ এর অনুগ্রহে আমাদের জীবন হবে চির ধন্য। আমরা হব চির অমর। যুগ যুগ ধরে খৃস্টধর্মে বিশ্বাসীরা আমাদের নাম শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করবে।
অপর দুই বন্ধু বলল, বন্ধু! তুমি এক চমৎকার প্রস্তাব দিলে। আমরা প্রস্তুত।
কথা চলাকালে আইনী এসে তাদের পাশে বসেছিল। সবকিছুই সে শুনেছে। তার মনেও ছিল দুঃসাহসিক কিছু একটা করার অনন্ত জোয়ার। স্বামী ও তার বন্ধুদ্বয়ের কথাবার্তা শুনে সে তেজোদ্বীপ্ত কণ্ঠে বলল, আমিও থাকব আপনাদের পাশে। খৃস্টধর্মের জন্য জীবন কুরবান করতে আমিও প্রস্তুত।
বিন ইয়ামীনের আস্তাবলে বেশ কিছু ঘোড়া ছিল। এক রাতে তারা আস্তাবল থেকে চারটি ঘোড়া নিয়ে সবার অজ্ঞাতসারে বেড়িয়ে পড়ল। বিন ইয়ামিনের আস্তাবলে কোন প্রহরী ছিল না। তাই কেউ তাদের ব্যাপারে কিছুই জানতে পারল না।
***
সকালের সূর্য যখন নিটোল চেহারায় হাসতে হাসতে উদ্ভাসিত হল তখন তারা অনেক দূর চলে গেছে। দুর্গম পথ, বালিয়াড়ির পর বালিয়াড়ি আর মরুভূমি অতিক্রম করে তারা এখন অনেক দূরে। বিন ইয়ামিনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বিন ইয়ামিন সকালে সংবাদ পেল যে তার আস্তাবলের চারটি ঘোড়া নেই আর। সেই চারজন লোক উধাও। ইবনে সামির, আইনী আরো দুজন। এ সংবাদে বিন ইয়ামিন ভারাক্রান্ত হল। বিষণ্ণতার একটা মলিন সূক্ষ পর্দা যেন তার উজ্জ্বল চেহারায় আবরণ ঢেলে দিল। বিন ইয়ামিন তাদের সম্পর্কে কিছুই বললেন না। কেন যেন নিরব রইলেন।