হযরত ওমর (রা.) বিষয়টি অবহিত হয়ে নিয়মানুসারে সাহাবীদের পরামর্শ সভা আহ্বান করলেন। উপস্থিত হলেন মদীনায় অবস্থানরত বিজ্ঞ সাহাবীগণ। বিষয়টি শোনার পর প্রত্যেকে নিজ নিজ মত ব্যক্ত করলেন। হযরত আলী (রা.) বললেন, মদ পান করলে মানুষ বুদ্ধিশক্তি হারিয়ে ফেলে। ফলে মুখে যা আসে তাই বলে। আল্লাহর রাসূল ও কুরআনের ব্যাপারেও তারা অকপটে মিথ্যা বলতে পারে।
হযরত আলী (রা.)-এর একথা শোনার পর হযরত ওমর (রা.)-এর মুখ দিয়ে হঠাৎ অবলীলাক্রমে বেরিয়ে এল, তাহলে মদ পানের শাস্তি হল তাকে আশিটি চাবুক মারা!
তখন হযরত ওমর (রা.) আবু উবায়দা (রা.)-এর নিকট লিখে পাঠালেন, যারা মদ পান করে তাদের ধরে আন। যদি তারা মদ পানকে হালাল মনে করে তবে তাদের হত্যা করে দাও। আর যদি তারা স্বীকার করে যে, মদ পান করা হারাম তবে তাদের প্রত্যেককে আশিটি চাবুক মার। এটাই মদ পানের শাস্তি।
আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.)-এর নির্দেশ পেয়ে আবু উবায়দা (রা.) তালাস করে করে সব মদ পানকারীকে ধরে আনালেন। হয়তো তারা বুঝে ফেলেছিল যে, যদি তারা বলে যে মদ পান করা হালাল তাহলে তাদের হত্যা করা হবে। তাই তাদের কেউ বলল না যে, মদ পান করা হালাল। সবাই এক বাক্যে বলল, মদ পান করা হারাম।
তারপর আবু উবায়দা (রা.) বললেন, হে মুসলিম ভাইয়েরা! তোমাদের উপর আল্লাহর কোন না কোন শাস্তি আসবে। আমি তোমাদের প্রত্যেককে আশিটি করে চাবুক মারার শাস্তি দিচ্ছি। তারপর তাদের প্রত্যেককে শাস্তি প্রদান করা হল। তারপর শামের কোন মুসলমান মদ পান তো দূরের কথা, মদের নামগন্ধ নেয়ারও সাহস পায়নি।
৬. কয়েক মাস কেটে গেল
কয়েক মাস কেটে গেল। ইবনে সামির এখনো বিন ইয়ামিনের নিকট অবস্থান করছে। এর মধ্যে বিন ইয়ামিন ইবনে সামির ও আইনীর শুভ বিবাহও সম্পাদন করে দিয়েছে। ইবনে সামির একজন দৈনিক। বেকার বসে থাকা তার ধাতে সয় না। তাই কিছু একটা করার জন্য সে অস্থির হয়ে পড়ল।
এ ছাড়াও সে এক কট্টরপন্থী গোঁড়া কিবতী খৃস্টান। সে ছিল বিন ইয়ামিনের গুপ্তচর। নানা ধরনের সংবাদ সে বিন ইয়ামিনের নিকট পাঠাত। কিন্তু এখন সে বেকার নিষ্কর্ম হয়ে পড়ে আছে। বিন ইয়ামিন তাকে কোন কাজ দিচ্ছে না। তার কারণ, ইবনে সামির পলাতক সৈনিক। দুজন সৈন্যকে হত্যা করে সে পালিয়ে এসেছে। তদুপরি একজন অপহৃত যুবতাঁকে সাথে করে যদি সে ধরা পড়ে তাহলে হত্যা ছাড়া তার অন্য কোন শাস্তি হবে না। এ সব বিবেচনা করেই বিন ইয়ামিন এখন তাকে কোন কাজের দায়িত্ব দিচ্ছে না। এদিকে ইবনে সামির বেকার থাকতে থাকতে একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।
সম্রাট হিরাক্লিয়ার্সের প্রাসাদ পর্যন্ত বিন ইয়ামিনের গুপ্তচর বাহিনী ছড়িয়ে আছে। সে সময় মিশরে সম্রাট হিরাক্লিয়ার্স থাকত না, বাইজেন্টাইনে থাকত। তবে মিশরের শাসন কার্য পরিচালনা করত সম্রাটের নিযুক্ত প্রাদেশিক গভর্নর মুকাওকিস। আর সামরিক বিষয়গুলো পরিচালনা করত সম্রাটের নিযুক্ত এক প্রসিদ্ধ জেনারেল আতরায়ূন।
মুসলমানরা শাম পদানত করে নেয়ার পর সম্রাট তা পুনরায় দখল করার চিন্তায় বিভোর ছিল। তাই সৈন্য বাহিনী পুনর্গঠনের প্রতি তার দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল।
একদিন বিন ইয়ামিনের নিকট দুব্যক্তি এল। এরা তারই নিযুক্ত গুপ্তচর। মিশরের রাজ প্রাসাদে তারা নিয়োগপ্রাপ্ত। কিছুদিনের জন্য তারা বাইজেন্টাইনে এসেছে। বিন ইয়ামিন তাদের নিকট খবরাখবর জানতে চাইলে তারা বলল, সম্রাট হিরাক্লিয়ার্সের মাথায় এখন শামের চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে। অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে সে শামে সৈন্য পাঠানোর চিন্তা করছে।
আরবে যখন দুর্ভিক্ষ চলছিল তখন হিরাক্লিয়ার্স সেখানে সৈন্য পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু সম্রাটের পরামর্শদাতারা তাকে বারণ করে বলল, এ দুর্ভিক্ষ শুধু আরবে। শামে কোন দুর্ভিক্ষ নেই। রোমান সৈন্যরা আরবে প্রবেশ করলে শাম থেকে মুসলিম বাহিনী দ্রুত আরবে ছুটে আসবে এবং পিছন দিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলবে। ফলে রোমান বাহিনীর যে কি অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয়।
তারপর তারা বলল, এর কিছুদিন পর শামে যখন মহামারী দেখা দিল, হাজার হাজার মানুষ যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে লাগল, তখন সম্রাট হিরাক্লিয়াস শাম আক্রমণ করার ইচ্ছে করল। সম্রাটের পরামর্শ দাতারাও এবার আক্রমণের পক্ষে মত দিল। সম্রাট এতে মহা খুশি। কিন্তু মহাপাদ্রী কীরস ভেবে চিন্তে বলল, সম্রাট মহাশয়! যদি রোমান সৈন্যরা শামে প্রবেশ করে তাহলে। তাদের মাঝেও মহামারী ছড়িয়ে পড়বে। ফলে অবস্থা এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে যে, পশ্চাতে ফিরে আসা বা মুসলিম বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়া ছাড়া আর কোন পথ থাকবে না।
এছাড়া যদি মিশর থেকে রোমান সৈন্যদের শামের যুদ্ধ ময়দানে নেয়া হয় তাহলে এই সুযোগে কট্টরপন্থী কিবতী খৃস্টান ও অন্যান্য খৃস্টান দলগুলো বিদ্রোহ করে বসবে। মিশরে অবশিষ্ট সামান্য সৈন্যরা তাদের দমন করতে ব্যর্থ হবে। ফলে মিশর হাত ছাড়া হয়ে যাবে আর শামও পুনর্দখল করা সম্ভব হবে না।
গুপ্তচরদ্বয় আরো বলল যে, মিশর শাসক মুকাওকিস ও সেনাপতি আতিরাবুন হিরাক্লিয়াসকে এ পরামর্শ দিচ্ছে যেন তারা শামের খৃস্টানদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উৎসাহিত করে এবং ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়। মুকাওকিসের এ পরামর্শ তারা উভয়ে পছন্দ করেছে। তবে তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ এখনো নেয়া হয়নি।