মদীনায় পৌঁছার পর তার মনের আকাশে নানা চিন্তা ভিড় করতে লাগল। মুহূর্তকালের জন্য তিনি স্বস্তি পাচ্ছেন না। ঘুরে ঘুরে শামের কথা মনে পড়ে। শামের জনগণকে কিভাবে মহামারী থেকে বাঁচানো যায় শুধু তারই চিন্তা করেন। আবু উবায়দা (রা.)-এর কথাই বারবার তার হৃদয়পটে উদ্ভাসিত হয়। আবু উবায়দা (রা.) একজন সুদক্ষ সিপাহ সালার। তাকে রক্ষার কথাই বারবার মনে পড়ে। মদীনায় ফিরে আসার সময় তিনি আবু উবায়দা (র.)-কে বলেছিলেন, চলুন, আমাদের সাথে মদীনায়। কিছুদিন সেখানে থেকে আসুন। কিন্তু আবু উবায়দা (রা.) অত্যন্ত দৃঢ় ও স্থির কণ্ঠে বলেছিলেন, আমি আমার সাথীদের মৃত্যুর মুখে ছেড়ে চলে যেতে পারি না। তারপর বললেন, আমি আল্লাহর ফায়সালা থেকে পালিয়ে যেতে পারি না।
মদীনায় পৌঁছে ভেবেচিন্তে তিনি আবু উবায়দা (রা.)-এর নিকট পত্র লিখে একজন অশ্বারোহী বার্তাবাহককে পাঠিয়ে দিলেন। লিখে পাঠালেন, আমি এক জরুরী বিষয়ে তোমার সাথে সরাসরি আলোচনা করতে চাই। পত্র পওয়া মাত্র মদীনায় চলে আসবে।
আবু উবায়দা (রা.) পত্র পাঠ করে ভাবনার জগতে হারিয়ে গেলেন। দূর নিকট অনেক কিছু ভাবরেন। তারপর উত্তরে লিখলেন, যে বিষয়ে আপনি আমার সাথে পরামর্শ করতে চাচ্ছেন তা মুলতবী হতে পারে। কিন্তু আমি এখানে মুসলিম বাহিনীর সিপাহ সালার। আমি আমার বাহিনীকে এ মহাবিপদের মাঝে ফেলে কোথাও যেতে পারি না। আমি আমার সাথীদের ছেড়ে যেতে পারি না। আমি এখানেই আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষায় থাকব।
হযরত ওমর (রা.) পত্র পাঠ করার পর ভাবাবেগে ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। তার চোখ থেকে ঝরঝর করে অশ্রু-প্রবাহিত হতে লাগল। উপস্থিত লোকদের একজন ত্রস্ত কণ্ঠে বলল, আমীরুল মুমিনীন! আবু উবায়দার কোন কিছু ঘটেনি তো? হযরত ওমর (রা.)-এর কণ্ঠস্বর জড়িয়ে এল। কান্নামাখা কণ্ঠে বললেন, না…..তবে মনে হচ্ছে সে আমাদের রেখে চলে যাবে।
তারপর হযরত ওমর (রা.) আবু উবায়দা (রা.)-এর পত্রটি উপস্থিত লোকদের পাঠ করার জন্য দিলেন। তারপর বহু চিন্তা-ভাবনার পর তিনি আবু উবায়দা (রা.)-এর নিকট আরেকটি পত্র লিখে পাঠালেন। হে আবু উবায়দা! নিচু অঞ্চল ত্যাগ করে উঁচু স্থানে চলে যাও। মুজাহিদদেরও তোমার সাথে নিয়ে যাও। হযরত আবু উবায়দা (রা.) হযরত ওমর (রা.)-এর পরামর্শ মোতাবেক আমল করার কথা চিন্তা করছিলেন। ঠিক তখনই তিনি মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন। তৃতীয় দিনে তিনি ইন্তেকাল করলেন। যেদিন তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন সেদিনেই মুয়ায ইবনে জাবাল (রা.)-কে তার স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন। অবস্থা এতো ভয়াবহ ছিল যে, এ মহামারীতে মুয়ায (রা.)-এর দুই যুবক পুত্র ইন্তেকাল করেছিলেন। কিছুদিন পর তিনিও ইন্তেকাল করলেন। ইন্তেকালের আগে তিনি আমর ইবনে আস (রা.)-কে তার স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন।
আমর ইবনে আস (রা.) সিপাহসালার হওয়ার সাথে সাথে মহামারী আক্রান্ত সকল এলাকার লোকদের নির্দেশ দিলেন, তারা যেন জনবসতি ত্যাগ করে পাহাড়ে চলে যায়। সাথে সাথে সবাই ঘরবাড়ি ফেলে পাহাড়ে চলে গেল। তারপর থেকে মহামারীর প্রকোপ কমে এল। ধীরে ধীরে তা শেষ হয়ে গেল। কয়েক মাসের এ মহামারীতে পঁচিশ হাজার মুসলমান ইন্তেকাল করল। যে সব সালার এতে ইন্তেকাল করেছেন তারা হলেন, আবু উবায়দা, মুয়ায ইবনে জাবাল, ইয়াযীদ ইবনে আবী সুফিয়ান, হারেস ইবনে হিশাম, সুহাইল ইবনে আমর, উতবা ইবনে সুহাইল (রা.) সহ আরো অনেকে। হারেস ইবনে হিশাম (রা.)-এর বংশের সত্তর জন এবং খালিদ ইবনে ওলীদ (রা.)-এর বংশের চল্লিশ জন মুসলমানও ইন্তেকাল করেছেন।
***
রাবেয়ার পিতা রাবেয়া ও ওয়াইসকে বলেছিল, শামে কিছু মুসলমান মদ হালাল মনে করে প্রকাশ্যে মদ পান শুরু করেছে। তখন ওয়াইস কঠোর ভাষায় তার প্রতিবাদ করেছিল। তারা বলেছিল, আপনি মুসলমানদের উপর মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছেন। আর এটা ইসলামের প্রতি আপনার বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ। আসলে রাবেয়ার পিতা মিথ্যা কথা বলেনি। তার কথার পিছনে কিছু বাস্তবতাও ছিল।
ঐতিহাসিকরা বলেন, মুসলমানরা শাম পদানত করলে আরবের কিছু গোত্র শামের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। শামের খ্রিস্টানরা তখন মুসলমানদের বশ্যতা মেনে নেয়। কিন্তু দুষ্টমতি কিছু খ্রিস্টান মুসলমানদের ধ্বংস সাধনের অন্য পন্থা অবলম্বন করল। তারা তাদের সুন্দরী রূপসী কন্যাদের মাধ্যমে ভুলিয়ে ভালিয়ে মুসলমানদের মদ পানে অভ্যস্থ করে তুলে।
পরহেজগার মুসলমানরা তাদের মদ পান করতে দেখে নিষেধ করলে তারা বলত, কুরআন মদ পানকে হারাম করেনি। কুরআন বলেছে, তোমরা কি এসব বস্তু পরিহার করবে না? তার অর্থ হল, আল্লাহ্ মদের বিষয়টি বান্দাদের জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছেন। বান্দা তা পরিহার করতেও পারে। আবার ইচ্ছে করলে গ্রহণও করতে পারে। দলীল হিসাবে তারা আরেকটি যুক্তি উপস্থাপন করে বলে, দেখ না প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর যুগে মদ পান করার কারণে কাউকে শাস্তি দেয়া হয়নি!
মদের ব্যাপারটি নিয়ে শামের কয়েকজন লোকে বাড়াবাড়ি করছিল। সিপাহ সালার আবু উবায়দা (রা.) বিষয়টি অবহিত হলেন। তিনি এ ব্যাপারটি তদন্ত করে তার সত্যতা যাচাই করলেন। মদ পানকারীদের বিভ্রান্তিকর প্রমাণ পেশের কথাও শুনতে পেলেন। তিনি দারুণ বিস্মিত হলেন। কিন্তু নিজে কোন ফয়সালা করলেন না। আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.)-এর নিকট বিষয়টি বিস্তারিত লিখে তার বিধান চেয়ে পাঠালেন। ১ ১৪১