সম্রাট হিরাক্লিয়াস কীরাসের কথায় একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। চেহারার আনন্দ আনন্দ ভাবটা কোথায় মিলিয়ে গেল। একটা বিমর্ষ ভাব চেহারায় ছড়িয়ে পড়ল। অতঃপর ধীরে ধীরে তার মাথাটি দুলে উঠল। বলল, আচ্ছা মহাপাত্রী কীরাস! তোমার কথাই আমার যুক্তিসঙ্গতি মনে হচ্ছে। এবারের মত আমি শাম আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকছি।
***
আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.) মহামারীর এ দুঃসংবাদ পাওয়ার পূর্বেই শামে যাওয়ার ইচ্ছে করেছিলেন। মহামারীর সংবাদ পাওয়ার পর তিনি বেচাইন হয়ে গেলেন। শামে গিয়ে স্বচক্ষে মহামারীর অবস্থা দেখে কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন। তাঁর সাথে অনেককে শামে যাওয়ার হুকুম দিয়ে নিজে তৈরী হয়ে গেলেন। শামের পথে মদীনা থেকে একটি কাফেলা রওনা হয়ে গেল।
তাঁরা আরবের প্রান্ত সীমায় এক তাঁবুতে গিয়ে পৌঁছলেন। হযরত ওমর (রা.) যাওয়ার আগেই শামের সর্বত্র সালারদের নিকট সংবাদ পাঠিয়েছিলেন যে, তিনি শামের অবস্থা স্বচক্ষে দেখে কার্যকারী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য শামের পথে রওয়ানা হয়েছেন। শামে অবস্থানরত সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.), সালার ইয়াজিদ ইবনে আবী সুফিয়ান, সুবাহবিল ইবনে হাসানা আরো অনেকে এসে তাঁবুতে হযরত ওমর (রা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলেন। তারা এক যোগে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আমাদের অনুরোধ, আপনি আর সামনে অগ্রসর হবেন না। শামের আকাশে বাতাসে মরণ ব্যাধীর জীবাণু জড়িয়ে আছে। মৃত্যু ছাড়া তা থেকে বাঁচার আর কোন উপায় নেই। তারা তাঁকে মহামারীর ভয়াবহতার বিস্তারিত বিবরন তার নিকট তুলে ধরলেন।
হযরত ওমর (রা.) দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, এখানে এসে গতি ফিরিয়ে দেয়া আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমি যদি এখান থেকে ফিরে যাই তাহলে মহামারীতে যারা ইন্তেকাল করেছে তাদের রূহের সামনে আমি লজ্জায় দাঁড়াতে পারব না। আমি মুসলিম ভাইদের এ মহাবিপদে ফেলে ফিরে যেতে পারি না।
আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.) স্বীয় মতে অটল অনড়। সালারগণ তাকে নানাভাবে বুঝালেন। বললেন, এখন এ সঙ্গীন মুহূর্তে যদি আমীরুল মুমিনীনের কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে ইসলামী জগতের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। যে ক্ষতিপূরণ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। হযরত ওমর (রা.) তাদের কোন কথাই কানে তুললেন না। অবশেষে তিনি উপস্থিত সবার নিকট থেকে পরামর্শ চাইলেন। তখন সেখানে বেশ কিছু বর্ষীয়ান সাহাবী উপস্থিত ছিলেন। পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রেও তারা দুদল হয়ে গেলেন।
কেউ কেউ বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের কল্যাণ কামিতার জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য শামে যাচ্ছেন। তাই ভবিষ্যতে কি হবে বা হতে পারে তা নিয়ে চিন্তা করার কোন অর্থ হয় না। ভাগ্যে যা আছে তা ছাড়া অন্যকিছু হবে না। নির্ভয়ে আপনি শামে যান।
অন্য সকলে বললেন, না, হে আমীরুল মুমিনীন! যে স্থানে ধ্বংস, বরবাদী ও মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই নেই সে স্থানে আমীরুল মুমিনীন এর যাওয়া কিছুতেই উচিত হবে না। আল্লাহ্ তাআলা আকল ও বুদ্ধি এজন্যই দিয়েছেন যে, যে কাজই আমরা করব তা ভেবে চিন্তে করব। হুট করে কিছু করা ঠিক নয়।
হযরত ওমর (রা.) দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। কি করবেন কিছুই স্থির করতে পারলেন না। অনেক চিন্তা ভাবনার পর কুরাইশ বংশের ঐসব সাহাবীকে ডাকলেন যারা মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলের সাথে ছিলেন এবং তখন তাঁবুতে অবস্থান করছিলেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) সেখানে ছিলেন। তাদের ডেকে তিনি পরামর্শ চাইলেন।
সিদ্ধান্ত হলো, আমীরুল মুমিনীন এখন তার কাফেলার সবাইকে নিয়ে মদীনায় ফিরে যাবেন। এই ফয়সালার পর হযরত ওমর (রা.)-এর মন স্থির হল। তিনি নির্দেশ দিলেন, আগামীকাল সকালে কাফেলা মদীনার পথে রওয়ানা হয়ে যাবে। সবাই যেন সফরের প্রস্তুতি নিয়ে নেয়।
এ ক্ষেত্রে ইতিহাস বিশারদগণ এক চমৎকার ঘটনা উল্লেখ করেছেন। আবু উবায়দা (রা.) শুরু থেকেই এমন পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন, যেন হযরত ওমর (রা.) শামে না যান। মদীনায় ফিরে যান। কিন্তু কখন যে তার মত পাল্টে গেছে তা জানা নেই। মদীনার দিকে যাত্রা শুরুর আগে হযরত আবু উবায়দা (রা.) অকপটে হযরত ওমর (রা.)-কে বললেন, হে ইবনে খাত্তাব! আল্লাহর ফয়সালা থেকে পালিয়ে যাচ্ছো?
এ কথা শোনার সাথে সাথে হযরত ওমর (রা.)-এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আবু উবায়দা (রা.)-এর দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন, হে ইবনে জাররাহ! যদি একথাটি অন্য কেউ বলত,….. হ্যাঁ আমি আল্লাহর এক ফয়সালা থেকে অন্য ফয়সালার দিকে যাচ্ছি। আবু উবায়দা (রা.) নিরব হয়ে গেলেন। ঠিক তখনই আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বর্ষীয়ান সাহাবী, দূরদর্শী। উপস্থিত হয়েই বুঝে ফেললেন মুহূর্তকাল পূর্বে এখানে কি ঘটেছে। মৃদু হেসে তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যদি তোমরা শুনতে পাও, অমুক স্থানে মহামারী দেখা দিয়েছে তাহলে সে স্থানে যেয়ো না। আর যদি তোমরা এমন স্থানে থাক যেখানে মহামারী দেখা দিয়েছে। তাহলে তোমরা সে স্থান ছেড়ে পালিয়ে এসো না। কারণ হয়তো তুমি তোমার সাথে এ মহামারী নিয়ে আসবে আর তা অন্য স্থানেও ছড়িয়ে পড়বে। রাসূলের বাণী শোনার পর হযরত ওমর (রা.)-এর মন একেবারে প্রশান্ত হয়ে গেল। দ্বিধা দ্বন্দ্বের আর কোন চিহ্ন বাকি রইল না। নিশ্চিন্ত মনে তিনি মদীনায় ফিরে এলেন।