আন্তোনীস আরো বলল, এটা রোম ও পারস্যের মত কোন বাদশাহী হবে না। এটা হবে ঈসা মসীহ এর সালতানাত। আরব কবিলাগুলোর সকল খ্রিস্টান যদি একমত হয় এবং আমার নেতৃত্ব মেনে নেয় তাহলে আমি তাদের নিয়ে একটি দুর্ধর্ষ বাহিনী গড়ে তুলব। তারপর অল্প সময়ের ব্যবধানে আমরা মুসলমানদের শাম থেকে তাড়িয়ে দেব।
আন্তোনীসের কথা শুনে বৃদ্ধের মলিন চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অধর কোণে একটি মিষ্টি হাসির রেখা বিকশিত হয়ে আবার মিলিয়ে গেল। মনে হল আন্তোনীসের মত চিন্তা ও ভাবনাই সে দীর্ঘদিন যাবৎ তার হৃদয়ের গহীন প্রকোষ্ঠে লালন করে আসছে।
বৃদ্ধ বলল, আমরা কখনো ইরানীদের গোলাম ছিলাম। কখনো ছিলাম রোমানদের একান্ত অনুগত প্রজা। আর এখন আমরা মুসলমানদের উন্মুক্ত তরবারীর নীচে অবস্থান করছি। গোটা এলাকার সংবাদ আমার নিকট আসছে। আমাদের কবিতাগুলো বিদ্রোহ করলেও তাদের মাঝে কোন ঐক্য নেই। সবাই বিচ্ছিন্ন। কেউ মুজাহিদদের মুকাবিলায় রণাঙ্গনে দাঁড়াতে পারছে না। বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ করছে। তাদের আনুগত্য স্বীকার করে নিচ্ছে। আমার দৃষ্টিতে এখন শুধুমাত্র আলেপ্পা শহরটিই বাকি আছে। আমি এখনো এই কেল্লা পরিবেষ্টিত শহরটির দিকে তাকিয়ে আছি। দুটি শক্তিশালী গোত্র এতে বসবাস করে। বনু রবীয়া ও বনু নুখ। এ পরিস্থিতিতে যদি আমরা আলেপ্পাবাসীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে পারি, মরণপণ যুদ্ধ করে মুজাহিদদের পরাজিত করতে পারি তাহলেই কবিলার অন্যান্য যোদ্ধাদের মনে সাহস সঞ্চারিত হবে। তারাও আমাদের পতাকা তলে ছুটে আসবে। আন্তোনীস বলল, তাহলে কি আপনি ঐ কবিলাগুলোর সর্দারদের এখানে ডেকে আনবেন? আমরা এখনো দৃশ্যপটে আসতে চাচ্ছি না। কারণ হতে পারে, সম্রাট হিরাক্লিয়াসের গুপ্তচররা আমাদের সন্ধানে প্রত্যেকটি অঞ্চল চষে ফিরছে।
বৃদ্ধ বলল, তোমাদের কোন ভয়ের কারণ নেই। যতক্ষণ আমাদের মাঝে আছো ততক্ষণ তোমাদের দিকে চোখ তুলে তাকাবারও কারো সাহস হবে না। কোন সর্দারকে এখানে ডেকে আনার প্রয়োজন নেই। আমি তোমাদেরকে আলেপ্পায় পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করছি। সর্দাররাই তোমাদের সাথে এসে দেখা করবে। আমি তোমাদেরকে কৃষক ও মজুরের ছদ্মবেশে আলেপ্পায় পৌঁছিয়ে দিচ্ছি।
সুদৃঢ় দুর্গবেষ্টিত আলেপ্পার পরিস্থিতি শান্ত। বিদ্রোহের কোন আলামত দেখা যাচ্ছে না। অল্পসংখ্যক মুজাহিদ স্থায়ীভাবে সেখানে আছে। শহরের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করা, কর ও জিযিয়া আদায় করা ইত্যাদি অত্যন্ত আবশ্যকীয় কাজ তারা আঞ্জাম দিচ্ছে। তবে ক্রমান্বয়ে মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরব কবিলা গুলোর খ্রিস্টান যোদ্ধারা সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। বিভিন্ন কবিলার সর্দাররাও সেখানে বসবাস করছে। সেখানে আসা যাওয়া করছে।
আন্তোনীস, রূতাস, লীজা ও ইউকেলিস যখন আলেপ্পা শহরে প্রবেশ করল তখন কেউ তাদের দিকে একবার ফিরেও তাকাল না। তাদের খোঁজ খবর নেয়ার প্রয়োজনও অনুভব করল না। এদের মত কতো বিপর্যস্ত মানুষ একের পর এক আলেপ্পায় আশ্রয় নিচ্ছে। তাদেরকেও তেমনি বিপর্যস্তই মনে করা হল। তাদের সাথে বৃদ্ধের প্রেরিত দুই ব্যক্তি ছিল তারা তাদেরকে এক সর্দারের বাড়িতে পৌঁছে দিল।
আলেপ্পায় পৌঁছে তারা বুঝতে পারল, যে বৃদ্ধের নিকট তারা পৌঁছেছিল তিনি সাধারণ লোক নন। আরব খ্রিস্টান কবিলাগুলোর সর্দাররা তাকে বিশেষ মর্যাদার নজরে দেখে। তার ইশারা-ইঙ্গিতে সকলে উঠাবসা করে। তাকে তারা দিক দিশারী প্রজ্ঞাবান মনে করে। এ কারণেই আন্তোনীস ও তার সাথীরা আলেপ্পায় আরব খ্রিস্টান সর্দারের বাড়িতে পৌঁছলে সর্দার তাদের সাগ্রহে বরণ করে নিয়েছেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আরো কয়েকজন সর্দার এসে উপস্থিত হল। আন্তোনীস তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করার পর তারা আলেপ্পার বাইরে থেকে আরো কয়েকজন সর্দারকে উপস্থিত করল। আন্তোনীসের পরিকল্পনা ও ইচ্ছার কথা শুনে তারা প্রীত হল। একমত হল। সবাই খ্রিস্ট রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল। কিন্তু কিভাবে বিদ্রোহের সূচনা হবে? কিভাবে বিজয়ের পথে এগিয়ে যাওয়া যাবে? এ আলোচনা শুরু হল। অনেক আলোচনা পর্যালোচনা হল। শেষে এক পরিকল্পনা তৈরী হল। এক কার্যপদ্ধতি নির্ধারিত হল।
সে অনুযায়ী সর্দাররা তাদের বিশেষ ব্যক্তিদের ডেকে আনলেন। তাদের জরুরী কিছু নির্দেশ দিয়ে বিদায় জানালেন। এর দুকি তিন দিনের মধ্যেই দুর্গ পরিবেষ্টিত আলেপ্পা শহরে অস্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন কবিলার লোকেরা আশ্রয় প্রার্থীর ভুতনে আসতে লাগল। বন্যার স্রোতের ন্যায় তারা একের পর এক আলেপ্পায় আসছে। শহরের মুজাহিদরা এর তত্ত্ব তালাশের কোন প্রয়োজন অনুভব করল না। আশ্রয় প্রার্থীদের সাথে যুদ্ধাস্ত্র ও আসছে। তীর, ধনুক, বর্শা আসছে, তুনীর আসছে। কিছু অস্ত্র খোলামেলাই আসল। আর কিছু অস্ত্র গোপনে এল।
রোমানরা এ শহর ছেড়ে চলে গিয়েছে। তাদের প্রাসাদগুলো ও রোমান সৈন্যদের ক্যাম্পগুলো খালি পড়ে আছে। তথাকথিত আশ্রয় সন্ধানীরা এসব খালি প্রাসাদ ও ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিতে লাগল। আশ্রয় প্রার্থীদের সংখ্যা অস্বাভাবিক বেড়ে গেল। খালি প্রাসাদ আর ক্যাম্পগুলোতে আর তিল ধারণের ঠাই নেই। এরপরও আরো আশ্রয় সন্ধানী এল। এরা খোলা মাঠে তাঁবু টানাতে লাগল। আন্তোনীস সর্দারদেরকে যুদ্ধের প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী দিচ্ছে। সর্দাররা তা তাদের বিশেষ ব্যক্তিদের সহায়তায় কবিলাগুলোর প্রত্যেক সদস্যের নিকট পৌঁছে দিচ্ছে। এভাবেই অত্যন্ত গোপনে বিদ্রোহের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে।