বাড়িতে প্রবেশ করেই ওয়াইস দেখল রাবেয়া বিমর্ষ বদনে বসে আছে। চোখে তার বিন্দু বিন্দু অশ্রু। ওয়াইসকে দেখেই ছুটে এসে বলল, ওগো! চলনা একটু বাড়িতে যাই। আমার ভাইটি মৃত্যুশয্যায় ছটফট করছে। এইতো কিছুক্ষণ আগে আমাদের এক প্রতিবেশী এইদিক দিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। আমাকে ভাইয়ের সংবাদ দিয়ে গেল। বলল, তোমার ভাই দুদিন যাবৎ জরাক্রান্ত। কেউ বলতে পারছে না কি হয়েছে। মাথা আগুন। কলসির পর কলসি পানি ঢালছে কিন্তু কোনই উপকার হচ্ছে না। আজ সকাল থেকে প্রলাপ বলছে। দুপুর থেকে অজ্ঞান। হতে পারে আজ রাতই তার জীবনের শেষ রাত।
ওয়াইস নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, তুমি যেতে চাইলে আমি বাধা দিব না। আর যদি আমাকে সাথে নিয়ে যেতে চাও তাহলে আমিও যাব।
ওরা রাবেয়াকে যদিও অপমান করে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল, কিন্তু তার হৃদয় কেন যেন ভাইয়ের নাম শোনা মাত্র বিচলিত হয়ে উঠল। সাথে সাথে সে ওয়াইসকে নিয়ে তার বাড়ির পথে রওয়ানা হয়ে গেল। গিয়ে দেখে, উঠানে লোকের ভিড়। ভিড় ঠেলে সে সামনে অগ্রসর হল। কেউ তাকে কিছু বলল না। ঘরে প্রবেশ করে দেখে, ভাইয়ের শয্যা পাশে তার পিতামাতা ও ভাবী কাঁদছে। ভাই রাবেয়াকে দেখার পূর্বে ওয়াইসকে দেখল। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তারপর চোখ খুলে কিছুক্ষণ বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে থেকে হঠাৎ একটি হেঁচকি দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। মাথা এক পার্শ্বে হেলে পড়ল। মৃত্যুবরণ করল।
ওয়াইস জানত না, এ লোকিটই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। আর সে তার ষড়যন্ত্রে আটকেও গিয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা বোঝা মুশকিল।
রাবেয়ার দুচোখ দিয়ে অশ্রুর ধারা নেমে এল। বেশ কিছুক্ষণ কাঁদল। কিন্তু তার পিতামাতা তার প্রতি বা ওয়াইসের প্রতি ফিরেও তাকাল না। রাবেয়া আবার বেদনাহত হৃদয় নিয়ে ফিরে আসল।
পরদিন শুনতে পেল, রাবেয়ার ভাইয়ের এক বন্ধুও অজানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে। দুদিন পর সেও মারা গেল। তারপর ঐ ব্যক্তিও একই রোগে আক্রান্ত হল যে ওয়াইসকে হত্যার জন্য নির্ধারিত স্থানে নিয়ে গিয়েছিল। দুদিন পর সেও মারা গেল। ওয়াইসকে যারা হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল একে একে তিনজনই মৃত্যুবরণ করল। অথচ ওয়াইস এ ব্যাপারে কিছুই জানল না।
***
কিন্তু এই ব্যাধি শুধুমাত্র এ তিনজনের মাঝে সীমিত রইলো না। বরং তা আলেপ্পার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। ঘর ঘর থেকে জানাযা বের হতে লাগল। চিকিৎসকরা অপারগ হয়ে গেল। মহামারির ভয়ে মানুষ স্তব্ধ হয়ে গেল। যে ব্যক্তি এ রোগে আক্রান্ত হয় দুই বা তিন দিনের মধ্যেই সে মৃত্যুবরণ করে। চিকিৎসকদের অবিরাম চেষ্টা সত্ত্বেও এ রোগ দূর হল না, উত্তরোত্তর তা গোটা শামে ছড়িয়ে পড়ল। ফিলিস্তিনের আমওয়াস নামক গ্রামে সর্বপ্রথম এ মহামারী শুরু হয়। তাই আমওয়াস ব্যাধি নামেই তা পরিচিত।
দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পেতে না পেতেই আবার ইসলামী জগতে দেখা দিল মহামারী। তখন ছিল ১৮ হিজরী মুতাবেক ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ। এ মহামারীর কারণে খিলাফতের ভিত কেঁপে উঠল। মুজাহিদদের ছাউনীতে ছাউনীতে এ মহমারী ছড়িয়ে পড়ল। অসংখ্য মুজাহিদ দেখতে দেখতে ইনতেকাল করল।
সম্রাট হিরাক্লিয়াস এ সংবাদ পেল। এবার আর তার আনন্দ ধরে রাখে কে? সাথে সাথে সভাসদদের ডেকে পাঠাল। বলল, মুসলমানদের পরাজয়ের এই হল মোক্ষম সুযোগ। মোসাহেবের দল তার অভিমত সমর্থন করল। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নিযুক্ত প্রধান পাদ্রী কীরাস সম্রাটের প্রতিজ্ঞার কথা শুনল। সম্রাটের নিকট এসে বলল, শাহানশাহে রোম! শুনতে পেলাম, আপনি শাম আক্রমণ করতে যাচ্ছেন। আপনার পরিষদও নাকি তা সমর্থন করেছে।
সম্রাট হিরাক্লিয়াস স্থির কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ, মহাপাদ্রী। শুধু শামই নয়, গোটা আরব আমি পদানত করতে চাচ্ছি। কিছুদিন আগে তারা দুর্ভিক্ষ আক্রান্ত হয়ে একেবারে দুর্বল নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে। এখন আবার তাদের উপর আরেক আযাব আপতিত হয়েছে। মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ মরছে। অনেক যোদ্ধা ও সালারও মারা গেছে। তাই ভাবছি, এটাই আক্রমণের মোক্ষম সুযোগ।
কীরাস কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল, যদি আপনার ক্ষতির কোন আশঙ্কা না থাকতো তাহলে আমিও আপনার কথা সমর্থন করতাম। কিন্তু আপনি আমার বাদশাহ্। আমার উপর আপনার অনুগ্রহের সীমা নেই। তাছাড়া আপনার সাথে আমার এক প্রবল আন্তরিক সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই যে পথে আমি আপনার ক্ষতির আশঙ্কা দেখব সে পথে চলতে আমি আপনাকে বারণ করব।
মহমান্য সম্রাট! আপনার একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করে আমরা আমাদের অর্ধেক সৈন্য হারিয়েছি। অবশিষ্ট যারা প্রাণে বেঁচে মিসরে এসে আশ্রয় নিয়েছে তাদের অন্তর থেকে এখনো আরবদের ভয় দূর হয়ে যায়নি। সেনা শিবিরে এখনো অনেকে দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে উঠে। তাই বলছিলাম, যদি এ অবশিষ্ট সৈন্যদের আপনি মহামারীর হাতে নিঃশেষ করতে চান তাহলে তাদের শামে পাঠান। আপনি কি একথা ভেবে দেখছেন না, মুজাহিদ শিবিরগুলোও যে মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এ মহামারী আমাদের সৈন্যদের কি খাতির করবে? কাল পর্যন্ত আমি যে সংবাদ পেয়েছি তাতে জানতে পেরেছি, মুসলমানদের বেশ কিছু সালারও ইতিমধ্যে মহামারীতে মারা গেছে।