ওয়াইসের কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর। বলল, সে আমার কি করতে পারবে। আমাকে কোথায় পাবে!
রাবেয়া যদিও ওয়াইসকে বলেছে যে, তার ভাই ভাল মানুষ নয়। তবে কেমন ভয়ঙ্কর ও দুরন্ধর তা সে ধারণা করতে পারেনি। রাবেয়ার এ ভাই মুসলমানদের ঘোর দুশমন। রোমানদের সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে কয়েকবার মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু এতে তার বিশ্বাস হয়ে গেছে যে, মুখোমুখি যুদ্ধে কখনো মুসলমানদের সাথে পেরে উঠা সম্ভব নয়। তাই সম্মুখ যুদ্ধ ত্যাগ করে সে এবার কূট কৌশলের পথ ধরেছে। গোপনে ধ্বংসাত্মক কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে। ইতিমধ্যে সে কয়েকজন সাঙ্গ-পাঙ্গও জোগার করে নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম শুরু হয়নি। হবে হচ্ছে করতে করতে সময় চলে যাচ্ছিল। রাবেয়া ও ওয়াইসকে দেখে তার সে আগুন যেন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল।
অবশ্য ধর্মের আকর্ষণেই যে তার এ অবস্থা এমন নয়। এর পশ্চাতে একটি ব্যর্থতাও কাজ করছিল। তা অনেক আগের কথা। বিয়ের অনেক আগে এক অনিন্দ্য সুন্দরীর সাথে তার ভাব জমেছিল। প্রেমের সেই অঙ্কুরটি এক সময় মহিরুহের রূপ ধারণ করেছিল। পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার জন্য তারা ছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কিন্তু এর মাঝে এক তুফান এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। রাবেয়া ও শারীনার মত সেও এক মুজাহিদের কথাবার্তা আর আচার-আচরণে বিমুগ্ধ-বিমোহিত হয়ে পড়েছিল। এমন কি মুসলমানও হয়ে গিয়েছিল। এবং রাবেয়ার ভাইকে ত্যাগ করে সে মুজাহিদের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিল।
এখন রাবেয়াকে এক নও মুসলিমের পাশে দেখে তার পূর্বের প্রেমের স্মৃতি কথা মনে পড়ে গেল। সাথে সাথে এক ভয়ঙ্কর জিঘাংসা ভাব তার হৃদয়ে লকলকিয়ে উঠল। ওয়াইস ও রাবেয়া চলে যাওয়ার পর পরই সে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেছে। সে তার দুই অনুসারীকে ডেকে ওয়াইস ও রাবেয়ার কথা শুনাল। সব শেষে বলল, ওয়াইস চায় এ গাঁয়ে ইসলাম প্রচার করবে।
এক অনুচর বলল, এতো বড় স্পর্ধা! এতো দুঃসাহস! হুকুম দাও দোস্ত কি করতে হবে? আমাদের গায়ে ইসলাম প্রচারের মজা তাকে দেখিয়ে দিব!
রাবেয়ার ভাই গলার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, কতল। আমরা আজ পর্যন্ত ইসলামের অগ্রযাত্রায় সামান্য বাঁধা সৃষ্টি করতে পারিনি। আমরা শুধুই পরিকল্পনার পর পরিকল্পনা করে আসছি। এবার বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হতে হবে।
হত্যার ব্যাপারে তারা একমত। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কিন্তু কিভাবে কোথায় তা করতে হবে, এ ব্যাপারে বেশ কিছুক্ষণ শলাপরামর্শ হল। অবশেষে তারা হত্যার এক পদ্ধতি বের করল। কে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ধোকায় ফেলে অকুস্থলে নিয়ে আসবে তাও নির্ধারিত হয়ে গেল।
এরপর চার পাঁচ দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু তারা ওয়াইসকে ষড়যন্ত্রের ফাঁদে ফেলতে পারেনি। কারণ ওয়াইস নিজের কর্তব্য কাজে দারুণ। ব্যস্ত। কারো সাথে কথা বলারও তার ফুরসত নেই।
***
একদিন বিকালে পড়ন্ত বেলায় ক্লান্ত শ্রান্ত ওয়াইস বাড়িতে ফিরছে। হঠাৎ পথিমধ্যে এক ব্যক্তি এসে সালাম দিয়ে সামনে দাঁড়াল। বলল, ভাই! আপনাকে আমি অনেক দিন ধরে চিনি। কিন্তু আপনার সাথে আমার পরিচয় হয়নি। একটি জরুরী কাজে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। শহরের বাইরে ঐ পথ দিয়ে একটু দূরে গেলেই আমাদের গ্রাম। সেখানে আমার প্রচেষ্টায় কয়েকজন খ্রিস্টান মুসলমান হতে ইচ্ছে করেছে। আপনাকে অবশ্যই আমার সাথে যেতে হবে। সন্ধ্যায় তারা পথের বাঁকে থাকবে। সন্ধ্যার পর আমরা সেখানে যাব। তাদের মুসলমান বানিয়ে কিছু মৌলিক শিক্ষা দিয়ে তবে আপনাকে ফিরতে হবে।
ইসলামের জন্য যে প্রাণ উৎসর্গিত সে প্রাণ কি এমন এক কাজ থেকে দূরে থাকতে পারে? এ ব্যাপারে গড়িমসি করতে পারে? তাই সাথে সাথে ওয়াইস প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। অগ্র পশ্চাৎ কিছুই সে ভাবল না।
আবীর ছড়াতে ছড়াতে সূর্য নিষ্প্রভ হয়ে পশ্চিমাকাশে অদৃশ্য হয়ে গেল। মাগরিবের নামাযের পরই লোকটি এসে হাজির। ব্যস্ত তার কণ্ঠ। বলল, চলুন, চলুন। দেরি হয়ে গেছে। রাতে রাতে আবার আপনাকে ফিরতে হবে যে। ঝটপট তৈরী হয়ে বের হয়ে এল ওয়াইস। কথা বলতে বলতে তারা চলতে লাগল।
***
কিছুক্ষণ চলার পর তারা শহরের বাইরে চলে এল। চারদিকে আবছা আবছা অন্ধকার। মেঠো পথ ধরে তারা কিছুদূর যাওয়ার পর পথের বাঁকে এসে উপস্থিত হল। কিন্তু কেউ সেখানে নেই। চারদিক নিরব নিস্তব্ধ। লোকটি বলল, হয়তো তারা এখনো এখানে এসে পৌঁছে নি। আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। এর মধ্যেই তারা চলে আসবে। কিছুক্ষণ তারা বসে রইল। না কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। লোকটি দারুণ অস্থির হয়ে পড়ল। বারবার এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। মাঝে মাঝে বিড় বিড় করে কি যেন বলছে। কিন্তু জনমানবের কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। ওয়াইস বলল, ভাই! আর তো অপেক্ষা করা যাচ্ছে না। যদি তারা সত্যই ইসলাম গ্রহণ করতে চায় তাহলে কাল তাদের সাথে করে নিয়ে এসো। আমি তাদের আমার চেয়ে বড় কারো নিকট নিয়ে যাব।
ষড়যন্ত্রকারী এই ব্যক্তি একাকীকিছু করতে সাহস পেল না। তা ছাড়া তার সাথে তো কোন অস্ত্র ও নেই। সে চালাকী করে কথার ছলে আরো কিছুক্ষণ ওয়াইসকে ধরে রাখল। কিন্তু না, কারো কোন সাড়াশব্দ নেই। তাই নিরাশ হয়ে ওয়াইস ফিলে এল।