ওয়াইস তাকে বলত, সে যেন তার পিতামাতা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করার জন্য এতো অস্থির ও উতলা না হয়। কারণ তারা তাকে দেখে আনন্দিত হবে না। তারা তার ইসলাম গ্রহণকে সহজে মেনে নিতে পারবে না। যেমন আমার পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজনরা তা সহজে মেনে নিতে পারেনি।
এ সবকিছু শোনার পরও রাবেয়ার নারী মন পিতামাতার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। সে প্রায়ই ওয়াইসকে বলে, আমি অবশ্যই আমার পিতামাতার সাথে সাক্ষাৎ করব। এর এক কারণ হল তারা আমার পিতামাতা। দ্বিতীয়ত আমার ইচ্ছে হয়, আমি তাদের নিকট ইসলাম ধর্মের দাওয়াত পৌঁছাই। রাবেয়ার এ কথা শুনে ওয়াইস হাসত। সে হাসি ছিল রহস্যময়।
সিপাহ সালারের নির্দেশে ওয়াইস আলেপ্পায় ফিরে এলে রাবেয়াও তার সাথে আলেপ্পায় চলে এল। এবার যেন তার আনন্দ কেউ ধরে রাখতে পারবে না। রাবেয়ার প্রত্যয়, সে এবার অবশ্যই তার পিতামাতা ও নিকটাত্মীয়দের সাথে সাক্ষাত করবে এবং ইসলামের সৌন্দর্য, কমনীয়তা তাদের সামনে তুলে ধরে তাদের ইসলাম গ্রহণে অনুপ্রাণিত করবে।
***
আলেপ্পায় পৌঁছে ওয়াইস রাবেয়াকে তার বাসায় নিয়ে গেল। আগে ওয়াইসের কোন বাসা ছিল না। ছাউনীতে মুজাহিদদের সাথে থাকত। কিন্তু রাবেয়াকে বিয়ে করে সাথে নিয়ে এলে তার জন্য একটি ছোট্ট বাসা বরাদ্দ করা হয়। সে বাসায় ওয়াইস রাবেয়াকে নিয়ে উঠে। আলেপ্পায় পৌঁছার পর রাবেয়া তার পিতামাতার সাথে দেখা করতে অস্থির ব্যাকুল হয়ে গেল। তাই একদিন ওয়াইস রাবেয়াকে নিয়ে রওয়ানা দিল। কিন্তু যাওয়ার প্রাক্কালে রাবেয়াকে বুঝিয়ে বলল যে, আমি তোমর সাথে যাব কিন্তু প্রথমেই তোমাদের বাড়িতে প্রবেশ করব না। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব। যদি তোমার পিতামাতা আমাকে সানন্দে গ্রহণ করতে পারেন তাহলেই আমি অন্দরমহলে প্রবেশ করব। তাই তুমি প্রথমে পরিস্থিতি অনুধাবন করে আমাকে সংবাদ দিবে।
বাড়িতে পৌঁছে ওয়াইস বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। রাবেয়ার বয়স কম। অভিজ্ঞতাও অল্প। কিশোর কিশোরীদের মত আনন্দের আতিশয্যে লাফাতে লাফাতে সে বাড়িতে প্রবেশ করল। বাড়ির লোকেরা তাকে দেখে প্রথমে ভয় পেয়ে গেল। কারণ তারা জানে, রোজী পাগল হয়ে চলে গেছে। এক বৎসরের চেয়ে বেশী সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই সে মৃত্যুবরণ করেছে। রোজী কখনো ফিরে আসতে পারে না। এ হয়তো তার প্রেতাত্মা!
রাবেয়া অন্দর মহলে প্রবেশ করে পিতামাতা ও অন্যান্যদের দেখে বলল, আপনারা কেমন আছেন? আমি এখনো জীবিত আছি। বরং আগের চেয়ে অনেক ভাল অবস্থায় আছি।
মা মেয়েকে দেখে অস্থির কণ্ঠে দুহাত প্রসারিত করে বলল, হায় আমার রোজী! তুই এখনো দুনিয়াতে আছিস!
রাবেয়া বলল, মা, আমি আর তোমাদের সেই রোজী নই। আমি রাবেয়া হয়ে গেছি। আমি মুসলমান। আমার স্বামী বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে ভিতরে ডেকে আনছি।
মেয়ের কথা শুনে মায়ের প্রসারিত হাত নীচে নেমে এল। সে তার ইসলাম গ্রহণ করাকে মেনে নিতে পারল না। কিন্তু রাবেয়ার মনে তখন আনন্দের। ফল্গধারা। বাড়ির লোকেরা তার ইসলাম গ্রহণের কথা যে মেনে নিতে পারছে না, তা সে বুঝতে পারল না। সে তখনই ছুটে বাইরে চলে গেল এবং ওয়াইসকে হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির ভিতর নিয়ে এল। ওয়াইস মনে করল, রাবেয়া তার পিতামাতার অনুমতেক্রমেই তাকে ভিতরে আনছে, সে প্রতিবাদ না করে ভিতরে চলে এল।
ভিতরে প্রবেশ করেই ওয়াইস দেখতে পেল রাবেয়ার পিতা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওয়াইস মুসাফাহা করার জন্য দুহাত প্রসারি করে দিল। কিন্তু রাবেয়ার পিতা হাত প্রসারিত করল না। রাবেয়ার মা তাচ্ছিল্যের সাথে ওয়াইসের দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। রাবেয়ার এক বড় ভাই ও তার স্ত্রী বাড়িতে ছিল। তারাও ওয়াইসের দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল।
ওয়াইস দারুণ মর্মাহত ও বেদনার্ত হয়ে বলল, রাবেয়া! দেখলে তো? আমি যা বলেছিলাম তাই তো হচ্ছে। তাদের শুনাও, আমি তোমাকে কোথায় পেয়েছি। আর কিভাবে আমি তোমাকে মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করেছি। জামাতার সাথে কি আচরণ করতে হয় এ সৌজন্যবোধটুকুও তাদের নেই।
রাবেয়ার পিতার নিরস কণ্ঠ শোনা গেল। বলল, আমি তোমাকে জামাতা বানাইনি। তুমি ভ্রষ্ট। আমার মেয়েকেও তুমি ভষ্টতার শিকার করেছে। তাই আমরা তোমার সাথে ভাল আচরণ করতে পারছি না। তুমি পথহারা বিভ্রান্ত।
লজ্জা ও ক্রোধে রাবেয়ার চেহারা লাল হয়ে গেল। পিতামাতা, ভাই ও ভাবীর আচরণে সে একেবারে অধীর হয়ে পড়ল। কিন্তু পরক্ষণেই সে তার মনকে শক্ত করে তুলল। তার চেহারায় কেমন যেন কাঠিন্য কাঠিন্য ভাব ছড়িয়ে পড়ল। পরিস্থিতির মুকাবিলা করতে সে মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গেল। কিন্তু তবুও সে একেবারে প্রশান্ত হতে পারেনি। ক্রোধ মিশ্রিত কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, আপনারা আগে আমার কথা শুনুন। আমার জীবনের উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে গিয়েছিল তা অনুধাবন করুন। আল্লাহ্ তাঁর তিন ফেরেস্তা দ্বারা কিভাবে আমাকে উদ্ধার করালেন তাও শুনুন।
সবাই বসে পড়ল। রাবেয়া ওয়াইসকে তার পাশে বসাল। তারপর তার উপর দিয়ে যে লোমহর্ষক ভয়াবহ ঝড় বয়ে গেছে তা একের পর এক বর্ণনা করল। রাবেয়া বলতে বলতে যতই অগ্রসর হতে লাগল তার পিতামাতা ও পরিজনের অবস্থা ততই স্বাভাবিক হতে লাগল। সবশেষে এসে রাবেয়া বলল, আমি এমন অসহায় ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লাম যে আমার মৃত্যু ছাড়া বাঁচার উপায় ছিল না। ঠিক তখন ওয়াইস ও তার সঙ্গীদ্বয় ফেরেস্তার মত সেখানে উপস্থিত হয়ে আমাকে উদ্ধার করল। তারা ইচ্ছে করলে আমার সাথে যা তা করতে পারত। কিন্তু তারা আমার সাথে ফেরেস্তার মত আচরণ করেছে।