বিন ইয়ামীন তখন কিছু পাদ্রীয়ানা তাত্ত্বিক কথাবার্তা শুরু করল।
ইবনে সামির বলল, সম্মানিত মহামান্য মহাপাদ্রী! আমি মূর্খ। ধর্মীয় জ্ঞান বলতে কিছুই নেই আমার। তাই আপনার জটিল ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা বুঝার সামর্থ আমার নেই। আমি একজন সৈনিক। যুদ্ধ, হত্যা আর রক্তপাত আমার কাজ। সহীহ আকীদা-বিশ্বাস ও ধর্মমত প্রচার ও প্রসারের জন্য কাকে হত্যা করতে হবে, কাকে শাস্তি দিতে হবে, এ ধরনের নির্দেশ আমাকে দিন। আমি তা দক্ষতার সাথে পালন করতে পারব।
বিন ইয়ামীনের রহস্যময় কথা। বলল, সবকিছুর আগে এখন তোমাকে নিজের বাঁচার কথাই চিন্তা করতে হবে। তুমি সেনাবাহিনীর বিধান লঙ্ন করে যে অপরাধ করেছে তার যে কি শাস্তি তা তোমার জানা আছে। এখন আত্মগোপন করে থাক। কিছুদিন কেটে গেলে তোমাকে ছদ্মবেশে কাজে লাগান হবে।
ইবনে সামির বলল, আমি একটি কথা বলতে চাই। সম্রাট হিরাক্লিয়াস ধর্মকে অপমান করে যে শিক্ষা ইতিমধ্যে পেয়েছে তা থেকে কিন্তু সে একটুকুও গ্রহণ করেনি। গোটা শাম তার করতল মুক্ত হয়ে গেল। মুসলমানরা একটার পর একটা দুর্ভেদ্য শহর পদানত করে নিল। তার বাহিনীর অর্ধেকের চেয়ে বেশী সৈন্য রণাঙ্গনে কচুকাটা হয়ে শেষ হয়ে গেল। এখন যে সৈন্যগুলো তার অধীনে আছে তাদের মাঝে মুসলমানদের এমন ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে যে, যদি কেউ কৌতূহল বশতঃ একথা ছড়িয়ে দেয় যে, মুসলমানরা মিসর আক্রমণে এগিয়ে আসছে, ব্যস্ এ সংবাদ শুনেই মিসরের বাহিনীর কণ্ঠ শুকিয়ে যাবে। পালাই পালাই করে নিমিষে সেনা ক্যাম্প শূন্য হয়ে যাবে।
বিন ইয়ামীন বলল, ইতিহাস জ্বলন্ত সাক্ষ্য। কাল প্রবাহে যে কেউ ধর্ম নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চেয়েছে সে-ই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ইসলামের মত খ্রিস্টবাদ এমন এক ধর্ম যে ধর্ম সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। সম্রাট হিরাক্লিয়াস সেই আসমানী কিতাবকে বিকত করেছেন। অহঙ্কারে মদমত্ত হয়ে ধর্মকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু করেছেন। সে এখন দিশেহারা। আমি দিব্য চোখে দেখছি, মিসর তার হাত থেকে ছুটে যাচ্ছে। ধর্মানুসারীদের এভাবে দলে-উপদলে বিভক্ত করলে অন্ধকার ভবিষ্যৎ ধেয়ে আসবে।
ইবনে সামির বিজ্ঞেস করল। মুসলমানরা কি মিসর আক্রমণ করতে যাচ্ছে।
বিন ইয়ামীন বলল, ইতিমধ্যে হয়তো তারা মিসরের উপকণ্ঠে পৌঁছে যেত। কিন্তু মুসলমানদের উপর এমন এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের আযাব এসেছে যার কারণে গোটা আরবের লোকেরা অনাহারে মৃত্যুবরণ করছে। আমি সর্বদা সেখানের সংবাদ পাচ্ছি। দুর্ভিক্ষ শেষ না হলে মুসলমানরা মিসর আক্রমণ করবে না।
ইবনে সামির বলল, মহামান্য পাদ্রী! আমার মনে হঠাৎ একটি চিন্তা উঁকি দিয়েছে। মুসলমানরা যদি মিসর আক্রমণ করে তাহলে তো আমাদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। কিন্তু আমি চিন্তা করেছি, যেভাবে মুসলমানরা সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে তাদের দুশমন মনে করে ঠিক সেভাবে তারাও তো আমাদের দুশমন। তাহলে কি আমরা সে সময় সম্রাট হিরাক্লিয়াসের অফাদারী করব?
বিন ইয়ামীনের কণ্ঠ অত্যন্ত গম্ভীর শোনা গেল। বলল, হ্যাঁ, এ বিষয়টি নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। শামের তিনজন মুসলমান গুপ্তচর আমার নিকট এসেছিল। তারা নিজেদেরকে খ্রিস্টান বলে প্রকাশ করেছিল। কিন্তু আমি বুঝে ফেলেছিলাম যে, তারা গুপ্তচর। তারা আমার থেকে জানতে এসেছিল, যদি মুসলমানরা মিসর আক্রমণ করে তাহলে খ্রিস্টানরা যুদ্ধের আগেই সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে না যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায়? তাদের খলীফা বা সিপাহ সালারের উদ্দেশ্য, প্রথমে হিরাক্লিয়াসকে মিসর থেকে তাড়িয়ে দেয়া হোক, তারপর মুসলমান ও খ্রিস্টানরা পরস্পরে নিজেদের বিরোধ মীমাঙসা করে নিবে।
তোমার প্রশ্নের উত্তর হল, যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে তখন মিসরের খ্রিস্টানরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখবে। তবে এটা এখন আমার শেষ ফয়সালা নয়। একথা সত্য যে, মিসরীয়দের কিছুতেই সম্রাট হিরাক্লিয়াসের পাশে দাঁড়ানো উচিত নয়।
কেউ একজন যুবতী মেয়কে নিয়ে পালিয়ে এসেছে এটা খ্রিস্টান সমাজে কোন অপরাধের বিষয় নয়। তা নিয়ে ইবনে সামিরের কোন মাথা ব্যথাও নেই। কিন্তু দুজন সৈন্যকে হত্যা করে পালিয়ে আসা এক গুরুতর অপরাধ। এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তাই ইবনে সামিরকে কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকতেই হবে।
***
আরবের সেই দুর্ভিক্ষের কারণে সব পরিকল্পনা যেন ভণ্ডুল হয়ে গেল। আমর ইবনে আস (রা.)-এর মনে একবারও আর মিসর আক্রমণের কথা উদয় হয় না। দুর্ভিক্ষগ্রস্থ আরবদের খাবার সংগ্রহ করা ও কাফেলা বোঝাই করে তা পাঠানোই এখন তার প্রধান দায়িত্ব। ইরাক ও শামের গভর্নররা এখন একাজেই ব্যস্ত। এভাবে নয় মাস কেটে যাওয়ার পর তাঁরা সংবাদ পেল, আল্লাহ্ তাআলা রহমেরত বারি বর্ষণ করেছেন। আরবদের মাঝে আবার স্বস্তি ফিরে এসেছে। রুক্ষ ও জ্বলে পুড়ে প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়া বাগানগুলোতে আবার সজীবতা ফিরে এসেছে। খেজুর গাছের কাণ্ডে কাণ্ডে আবার কাদি দেখা দিয়েছে। গাছের ডালে ডালে আবার পাখিরা গান ধরেছে।
এ সংবাদ শুনে ইরাক ও মিসরের গভর্নররা শান্ত হল। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। আবার আত্মচিন্তা তাদের মাঝে ফিরে এল। রাবেয়াকে সে বারই আমর ইবনে আস (রা.) ওয়াইসের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। ওয়াইসের সাথে তার দুজন সাথী যারা মিসর গিয়ে বিন ইয়ামীনের সাথে সাক্ষাৎ করেছিল সে গুপ্তচর দুজনও শামেই থাকত। দুর্ভিক্ষ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.) আমর ইবনে আস (রা.)-এর নিকট বার্তা পাঠালেন যেন মিসরে প্রেরিত গুপ্তচর তিন মুজাহিদকে তারেদ স্ব স্ব স্থানে প্রেরণ করা হয়। ওয়াইস আলেপ্পার অধিবাসী। আলেপ্পার মুজাহিদ বাহিনীর সে একজন সদস্য ছিল। তাই সে আলেপ্পায় ফিরে যাওয়ার নির্দেশ পেল। মিসর থেকে ফিরে আসার পরই রাবেয়া বার বার ওয়াইসের নিকট বিনীত আবেদন করত যেন তাকে তার পিতামাতার সাথে দেখা করা সুযোগ দেয়া হয়।