উচ্চ পদস্থ সামরিক অফিসারটি বজ্র নিনাদ কণ্ঠে বলল, তোমরা এই লোকগুলোকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখ। এবারই তো ঐ লোক যারা ঐ স্থান থেকে এক কুমারী মেয়েকে নীল নদে নিক্ষেপ করে বিসর্জন দিয়েছিল। তারপর হোরসীসের মেয়েকেও বিসর্জন দিয়েছে।
হোরসীসের কণ্ঠ শোনা গেল, বলল, হ্যাঁ তারাই।
আরো দুতিন জন বলল, হ্যাঁ তারাই।
অফিসারটি ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, সবাই বল, এবার সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠল। বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ তারাই।
অফিসারটি ইংগিতে কি যেন বলল। অমনি একজন সৈন্য ছুটে গিয়ে তাদের পায়ের ভেড়ী ও হাতের শিকল খুলে তাদের নীল নদের তীরে দাঁড় করিয়ে দিল। অন্য কয়েকজন সৈন্যের হাতে তীর ও ধনুক ছিল। অফিসারের ইশারায় তারা ধনুকে তীর যোজনা করল। তারপর আবার ইশারা করা মাত্র ধনুকগুলো থেকে সাঁ সাঁ করে তীর উড়ে এসে তীরে দাঁড়ানো সকলের শরীরে বিদ্ধ হল। তাদের কয়েকজন আর্ত চিৎকার করে নীল নদে ধপাস করে পড়ে গেল। দুএকজন বেঁকে তীরে লুটিয়ে পড়ল। তাদেরকে সৈন্যরা পা দিয়ে লাথি মেরে পানিতে ফেলে দিল।
ঠিক তখন ইবনে সামির ও আইনী ঘোড়ায় চড়ে বহু দূরের এক বালুকাময় প্রান্তর অতিক্রম করছে। আইনী ইবনে সামিরের পিছনে ঘোড়ায় বসে আছে।
আইনী বলল, আমার শুধুমাত্র পিতামাতার কথা মনে পড়ে। আর তখন হৃদয় অস্থিরতায় ছটফট করতে থাকে। মনে হয় রোমান সৈন্যরা তাদের মেরে ফেলেছে।
ইবনে সামির বলল, আইনী! জীবনকে সফল করতে হলে কিছুতো কোরবানী দিতেই হয়। আমারো তো পিতামাতা আছে। তা সত্ত্বেও আমি আমাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলাম। ধরা পড়লেই আমাকে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়া হবে। আমি সেনা বাহিনীর আইনের বিরুদ্ধাচরণ করেছি। দুজন সৈন্য হত্যা করে তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়েছি। এখন আর পিছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। সামনের দিকে ছুটে চল। আমি তোমাকে মহা পাদ্রী বিন ইয়ামীনের নিকট নিয়ে যাচ্ছি। তিনি হয়তো বাঁচার কোন পথ দেখিয়ে দিবেন।
ইবনে সামির বিন ইয়ামীনের ঠিকানা জানত। কারণ সে বিন ইয়ামীনের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করত।
***
সম্রাট হিরাক্লিয়াস মহাপাদ্রী কীরাসকে যে কোন ধরনের নির্যাতন নিপীড়ন করে রাজকীয় খ্রিস্ট ধর্মকে গির্জায় প্রতিষ্ঠিত করার শক্তি ও ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছিল। পাদ্রী কীরাসের আঙ্গুলী হেলনে কেঁপে উঠত রোমান সৈন্য আর সেনাপতিরা। সকলে অবলীলায় তার নির্দেশ মানত। ধর্মীয় বিষয়ে সৈনিকরা তার হুকুমে নিরপরাধ নিষ্পাপ ব্যক্তিদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাত। নির্যাতনে নিপীড়নে রাজকীয় খ্রিস্টান ধর্ম মানতে বাধ্য হত।
কীরাস যদি শুনতে পেত, অমুক গির্জার পাদ্রী তার নির্দেশ মানে না। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের দেয়া ধর্মমতের বিরোধীতা করে। ব্যস্ এতটুকু সংবাদ-ই যথেষ্ট। তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে আসত তার বন্দীশালায়। তারপর হয়তো কাউকে বিবস্ত্র করে তার শরীরে জ্বলন্ত অঙ্গার ঠেসে ধরত। বা ফুটন্ত পানি শরীরে ঢেলে দিয়ে ঝলসে দিত। ফলে সে হিরাক্লিয়াসের প্রণীত ধর্ম মানতে বাধ্য হত।
গণমানুষের সামনে প্রকাশ্যে এমন কঠিন শাস্তি দিয়ে মানুষের মনে ভয়ভীতি আর আতঙ্ক সৃষ্টি করত। অপর দিকে হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে গোপন তৎপরতা চলছে পাদ্রী বিন ইয়ামীনের নেতৃত্বে। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ত তার নির্দেশ নামা। সাম্রাজ্যের চরদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মিসরের ঘরে ঘরে তা পৌঁছে যেত। সাম্রাজ্যের উঁচু-উঁচু পদে বিন ইয়ামীনের ভক্তরা নিরবে কাজ করত। জনমত সৃষ্টি করত। রোমান সৈন্যদের মাঝেও অনেকে বিন ইয়ামীনের ভক্ত। তার ধর্মদর্শনে বিশ্বাসী। ইবনে সামির তাদেরই একজন। তার বিশ্বাস, সম্রাট হিরাক্লিয়াসের হাত থেকে বাঁচতে হলে বিন ইয়ামীনের নিকট যেতে হবে। তিনিই তার এ সমস্যার সমাধান দিতে পারবেন।
***
আরো এক রাত ও একদিন ইবনে সামির ও আইনীকে পথেই কাটাতে হল। পরদিন তারা পাদ্রী বিন ইয়ামীনের নিকট গিয়ে পৌঁছল।
বিন ইয়ামীন দূরদর্শী। হাজার অভিজ্ঞতায় পরিপক্ক। ইবনে সামিরকে দেখে হেসে হেসে বলতে লাগল, ইবনে সামির! কি করে এলে? আর এই মেয়েটি কে?
তার কণ্ঠ থেকে মায়াময় মিষ্টতা ছড়িয়ে পড়ল। মনে হল যেন ইবনে সামিরের পথের সকল ক্লান্তি আর অবসাদ দূর হয়েছে গেছে।
ইবনে সামির মাথা নীচু করে বলল, হুজুর! আমিতো আমার আকীদা বিশ্বাসের জন্য উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু করতে পারিনি। তবে এ মেয়েটির জীবন রক্ষার জন্য আর আমার হৃদয়ে সুপ্ত আকাক্ষা বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল। আপনার দোয়ার বদৌলতে বেঁচে আসতে পেরেছি।
বিন ইয়ামীনকে ঘটনা বিস্তারিত শুনাল।
ঘটনা বর্ণনা শেষ হলে বিন ইয়ামীন শির দুলিয়ে বলল, খারাপ কিছু তো করনি। তুমি তোমার মহব্বতকে জীবিত রাখতে আর তোমার প্রেমাস্পদকে উদ্ধার করতে যে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে সত্যই তা প্রশংসনীয়। তুমি কিছুদিন আত্মগোপন করে থেকো।
ইবনে সামির বলল, আত্মগোপন করে তো থাকতেই হবে। কিন্তু নির্মা হয়ে বসে থাকতে চাই না। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের মনগড়া ঐ ধর্মমতকে উৎখাত করতে কিছু একটা করতেই হবে। আমি কি করব, আমাকে তার নির্দেশ দিন। আমি যে কোন কুরবানী দিতে প্রস্তুত।