***
আইনী তার পিতামাতার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। ঠিক তখন এ কাণ্ড ঘটল। ইবনে সামিরা দেখল, আইনীকে হোরসীসের মেয়ে বানিয়ে অফিসারের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। ইবনে সামিরা তা দেখে নিরব রইল।
তারপর যখন অফিসার আইনীকে নিয়ে নীল নদের তীরে দাঁড় করিয়ে দিল এবং ঘোষণা করল, যারা এ মেয়ের পিতামাতা তারা যেন এগিয়ে আসে অন্যথায় তাকে নীল নদে নিক্ষেপ করা হবে। ইবনে সামিরা দেখল, আইনীর প্রকৃত পিতামাতা এখন আর সামনে আসবে না। আর হোরসীসও সত্য বলবে না। ফলে রোমান অফিসারটি বাধ্য হয়ে তাকে নীল নদে নিক্ষেপ করবে। তখন ইবনে সামিরা সবার অজান্তে পল্লীতে চলে গেছে। দৌড়ে গিয়ে তার ঘোড়ায় লাফিয়ে উঠেছে। তারপরই ছুটে এসে আইনীকে নিয়ে ঝড়ের বেগে উধাও হয়ে গেছে।
রোমান অফিসারটি রাগে ক্রোধে অধীর হয়ে গেল। সে দেখল, হোরসীসও তার স্ত্রীর চেহারায় বেদনা বা আক্ষেপের কোন আলামত নেই। নির্বিকার প্রশান্ত তাদের চেহারা। কিন্তু তাতেকি হবে। কারা যে মেয়েটির পিতামাতা তা তো জানা যাচ্ছে না। কিন্তু যারাই পিতামাতা হোক তাদের তো এখন স্থির থাকার কথা নয়। তারা কিভাবে মেনে নিতে পারে যে, তাদের মেয়েকে এক সৈন্য নিয়ে পালিয়ে গেছে। এতো কিছুতেই সহ্য করা যায় না।
ইতিমধ্যে অফিসারটির দিকে আইনীর পিতা এগিয়ে এল। বলল, যে সৈন্যটি আমার মেয়ে আইনীকে নিয়ে পালিয়ে গেছে সে কে? কি তার পরিচয়? এতক্ষণ পর অফিসার সঠিক তথ্য উদ্ধার করতে পেরে ক্রোধে আগুন হয়ে গেল। সাথে সাথে নির্দেশ দিল এ পল্লীতে আগুন লাগিয়ে দাও।
অফিসারের নির্দেশ শুনে সবাই হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল। অনেকেই কাঁদতে কাঁদতে তার পায়ে লুটিয়ে পড়ল। অফিসার সবাইকে নিরব হতে নির্দেশ দিল। বলল, সবার হয়ে তোমাদের মধ্য থেকে একজন কথা বল।
কিন্তু সবাই বলল, হুজুর! আমরা অশিক্ষিত মূর্খ মানুষ। কুলি মজুর জেলে। ধর্মের বিষয় সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না। পাদ্রীরা আমাদের যা বলে আমরা তাই মেনে নেই। কোন পিতামাতাই তার যুবতী কন্যাকে নীল নদে নিক্ষেপ করতে চায় না। কিন্তু হুজুর আমাদের তো কিছুই করার নেই। পাদ্রীর নির্দেশ আমাদের বাধ্য হয়ে মানতে হয়। আমরা নিরূপায়। আমরা জুলুমের শিকার। ঐ পাদ্রীরা এসব ঘটায়।
রোমান অফিসার বলল, আমিও তোমাদের মতই খ্রিস্টান। কিন্তু আমি ঐ নীল নদে মানব সন্তান বিসর্জন দেয়াকে পাপ ও অমার্জনীয় অপরাধ মনে করি। আমরা যেখানে বিশ্বাস করি যে, হযরত ঈসা (আ.) মৃতদের জীবিত করেছেন সেখানে আমরা কীভাবে ঈসা (আ.)-এর নামের দোহাই দিয়ে জীবিতকে মারতে পারি? ঈসা (আ.) তো জীবনেও কাউকে হত্যা করেন নি। বরং তিনি কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করেছেন। দুনিয়ার মানুষের মাঝে ক্ষমা, ভালবাসা, আর প্রেমের কথা বলে গেছেন। হিংসা, বিদ্বেষ, হত্যা ইত্যাকার অপরাধ বর্জনের আহবান জানিয়েছেন। তোরমা কি জান না আমাদের খোদা কে? আমাদের খোদা ঐ মহান সত্ত্বা যার পরিচয় হযরত ঈসা (আ.) আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। নীল নদী আমাদের খোদা নয়। এটা কখনো হতে পারে না যে, খোদা একজন নিষ্পাপ নির্দোষ মানুষের হত্যা দেখে আনন্দিত ও বিমুগ্ধ হবেন!
তারপর অফিসারটি হোরসীসকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আমার সাথে মিথ্যা বললে কেন?
হোরসীস বলল, আমার মাত্র একটি সন্তান ছিল। আমি আমার সে মেয়েটিকে আদর সোহাগ দিয়ে লালিল পালিত করেছি। কিন্তু তারা বড় পাদ্রীর নির্দেশে তাকে নীল নদীবক্ষে বিসর্জন দিয়েছে। হুজুর আমি কখনো আপনাকে এ কথা বলতাম না। কিন্তু দেখছি, আমার একার অপরাধে আপনি আমাদের পল্লীটি জ্বালিয়ে দেবেন। তাই বলতে বাধ্য হলাম। যদি আমার এ অপরাধের কারণে পল্লীর লোকেরা আমাকে গাদ্দার হিসাবে চিহ্নিত করে ও শাস্তি দিতে চায়, তাহলে আমি তা মাথা পেতো বরণ করে নিব।
অফিসার গম্ভীর কণ্ঠে বলল, এ ভয় তুমি অন্তর থেকে দূর করে দাও। আমার উপস্থিতিতে কেউ তোমাকে কিছু বলতে পারবে না। আমি তোমাদের প্রশংসা করতে বাধ্য হচ্ছি। তোমাদের মাঝে ঐক্যের দুর্লভ এক গুণ রয়েছে। আমি তেমাদের এ ঐক্যকে অটুট রাখতে চাই। তোমাদের পল্লী কেউ জ্বালাতে পারবে না। তবে যদি এ পল্লীর কোন যুবতাঁকে আবার নদীবক্ষে উৎসর্গ করা হয় তাহলে সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বিধান মতে তোমাদের শাস্তি দেয়া হবে।
জনৈক ব্যক্তি বলল, হুজুর! আমরা তো আমাদের বড় পাদ্রীর নির্দেশ মেনে চলি। অফিসার তখন বড় পাদ্রীর নাম ধাম ও ঠিকানা জেনে নিল। তার সাথে কারা কারা এ কাজের সাথে জড়িত তাদের নাম ঠিকানাও জেনে নিল। হোরসীস জেলে পল্লীর সর্দার বাবাজ্বীর কথাও বলে দিল ও তার ঠিকানাও দিয়ে দিল।
সাথে সাথে রোমান অফিসারটি সকল সৈন্যকে একত্রিত করে বড় পাদ্রীর পল্লীর দিকে ঘোড়া ছুটাল। পল্লীতে বড় পাদ্রীকে ও তার সাঙ্গপাঙ্গকে পেয়ে তাদের গ্রেফতার করল। তারপর সে রাতেই জেলে পল্লীর সর্দার বাবাজ্বীকেও গ্রেফতার করে আনল।
***
পরদিন সেই রোমান অফিসার ঘোড়ায় চরে আবার সেই পল্লীতে গিয়ে উপস্থিত। আজ তার সাথে উচ্চ পদস্থ আরেক জন সামরিক অফিসার রয়েছে। তাদের পশ্চাতে রয়েছে বড় পাদ্রী, পাদ্রীর তিন চারজন অনুসারী, জেলে পল্লীর বাবাজ্বী। এদেরকে শিকলে বেঁধে আনা হয়েছে। তাদের পায়ে লোহার বেড়ী লাগান। পল্লীর সবাইকে বাইরে একত্রিত করা হল। শিকলাবদ্ধ সবাইকে নীল নদের ঐ উঁচু স্থানে নিয়ে দাঁড় করানো হল যেখান থেকে নীল নদে কুমারী মেয়েদের উৎসর্গ করা হয়।