হঠাৎ সবাই বিস্মিত নয়নে দেখল, পল্লীর এক পার্শ্ব থেকে এক ঘোড়া ধূলা উড়িয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে এল। সবাই সেদিকে তাকিয়ে রইল। অশ্বারোহী রোমান বাহিনীর একজন উচ্চ পদস্থ সৈন্য। চোখের পলকে তার ঘোড়াটি মেয়েটির দিকে ছুটে গেল।
অশ্বারোহী চিৎকার করে আওয়াজ দিল, আইনী হুশিয়ার! মেয়েটি দেখল, ঘোড়াটি তার দিকে ছুটে এসেই অশ্বারোহী হাত প্রসারিত করে তাকে তার পশ্চাতে তুলে নিতে চাচ্ছে। মেয়েটি চোখের পলকে তার পশ্চাতে উঠে বসল। ঠিক তখন যে সৈন্য দুজন দুপাশে দাঁড়িয়ে ছিল ঘোড়ার সামনে এসে দাঁড়াল। সে তাদের এমনভাবে আঘাত করল যে তাদের একজন নদীবক্ষে গিয়ে পড়ল। আরেকজন ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল।
তারপরই ঘোড়া উল্কার গতিতে ছুটে চলল। মেয়েটি দুহাতে অশ্বারোহীর কোমর ধরে আছে আর ঘোড়া ছুটে চলছে। রোমান সৈন্যদের ঘোড়া অদূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। আফিসার তার পশ্চাদ্ধাবন করতে নির্দেশ দিলেন।
নির্দেশ পেয়ে কয়েকজন সৈন্য ছুটে গিয়ে ঘোড়ায় চড়ল। ঘোড়া ছুটল পিছু পিছু। কিন্তু ইতিমধ্যে সে ঘোড়া বহু দূর চলে গেছে। দূর থেকে শুধু তার পদধ্বনি শোনা যায়। ধূলি বালু উড়িয়ে সে বহুদূর চলে গেছে। পশ্চাদ্ধাবন করে আর কোন লাভ নেই। কারণ সামনে পাহাড়ী পথ ও ঝোঁপ ঝাড়। রোমান সৈন্যরা আরো কিছু দূর গিয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে এল।
***
রোমান এ সৈন্যের নাম ইবনে সামির। যুবক, সুশ্রী, অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী। সে যখনই টহল দিতে বেরুত তখনই এ পল্লীতে এসে উপস্থিত হত। একদিন এক নির্জন পথে আইনী ও ইবনে সামির মুখোমুখী হল। ইবনে সামির পথ রোধ করে দাঁড়াল। আইনীর চোখে মুখে ভূবন মোহিনী মৃদু হাসির ঝলক ফুটে উঠল। তারপরই তার নিষ্পাপ নির্মল চেহারায় ভয়ভীতির ছাপ ফুটে উঠল।
আইনী মিষ্টি ভাষায় বলল, আপনি রোমান সৈন্য তাই-না? আপনারা যা খুশি তাই করতে পারেন। আমাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উত্থাপন করাই যথেষ্ট যে আমরা মিসরী খ্রিস্টান। রাজকীয় খ্রিস্টান ধর্মকে আমরা মানি না। আচ্ছা আপনি কি আমাকে তুলে নিয়ে যাবেন?
এতক্ষণ পর্যন্ত ইবনে সামিরার অন্তরে একটি রোমান রোমান ভাব বিরাজমান ছিল। আত্ম অহংকারে বিভোর ছিল। কিন্তু আইনীর মার্জিত সুমিষ্ট কথা ও নমনীয় ভাব তার হৃদয়কে প্রভাবিত করল। সে পথ ছেড়ে দিল। কিন্তু আইনী পালিয়ে না গিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
ইবনে সামিরার কণ্ঠে এবার কথা ফুটে উঠল। বলল, আইনী! আমি তোমার নাম জানি। দূর দূর থেকে তোমাকে দেখি। পছন্দ করি। আমার বদ নিয়ত থাকলে তোমাকে তুলে নেয়া আমার জন্য কোন মুশকিল বিষয় নয়। আমি তোমার পিতা-মাতাকে যে কোন সময় ক্যাম্পে ডেকে নিতে পারি। তাহলে তুমিও স্বেচ্ছায় ক্যাম্পে ছুটে আসবে।
ইবনে সামিরের কথায় আইনী মুগ্ধ হল। কথার আবেশে আইনী যেন তার প্রেমের জালে পা দিল। এরপর কয়েকবার আইনী ইবনে সামিরের সাথে সাক্ষাৎ করেছে। ইবনে সামিরা আইনীকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, সে কিছুতেই তার ইজ্জত ও মর্যাদায় আঘাত করবে না। বরং সে তার ইজ্জত ও মর্যাদার এক বিশ্বস্ত প্রহরী।
একদিন আইনী ইবনে সামিরের সাথে সাক্ষাৎ করলে ইবনে সামির বলল, আজ আমি তোমাকে আমার জীবনের এক রহস্যময় কথা বলব। আমার বিশ্বাস, এখন তুমি আর আমার ক্ষতির চিন্তা করতে পারবে না। আমি তোমাকে এতটুকু বিশ্বাস করি। আসলে আমি রাজকীয় খ্রিস্টান ধর্মের বিশ্বাসী নই। সম্রাট হিরাক্লিয়াস আর পাদ্রী কীরাসের ধর্মমতকে আমি মানি না। আমার অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হলেন মহান পাদ্রী বিন ইয়ামীন। তিনি মেয়েদের নীল নদে বিসর্জনের পক্ষপাতী নন। তিনি এর ঘোর বিরোধী।
ইবনে সামিরা আর আইনী উভয়ে খ্রিস্টান। ইচ্ছে করলেই দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। কিন্তু ইবনে সামিরা মনে করে আইনীর পিতা মাতার অনুমতি নেয়াটা জরুরী বিষয়। একদিন সে আইনীর পিতামাতার সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছে। তখন তারা একে অপরের দিকে রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিরব থেকেছে। কিছুক্ষণ পর আইনীর পিতা বলেছে, আমি ভেবে চিন্তে আইনীকে আমার মতামত বলে দিব। আইনীর থেকে তা জানতে পারবে।
পরদিন ইবনে সামিরা টহল দেয়ার নামে পল্লীতে এলে আইনী পল্লীর বাইরে নির্জনে গিয়ে তার সাথে মিলিত হল। বলল, না, ইবনে সামিরা! আমার পিতামাতার কেউ এতে রাজি নয়। তারা বলছেন, ফৌজের লোকদের বিশ্বাস করা যায় না। তাছাড়া ফৌজের লোকেরা রাজকীয় খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী হয়।
ইবনে সামিরা বলল, আমার ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপারে তুমি তাদের কিছু বলছ?
আইনী বলল, হ্যাঁ, আমি তাদের বলেছি, ইবনে সামিরা রাজকীয় খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী নয়। সে মহা পাদ্রী বিন ইয়ামীনের অনুসারী। আমাদের মতই তার ধারণা বিশ্বাস। আমার কথা শুনে পিতা বলেছেন, তাহলে সে মিথ্যা বলেছে। ফৌজের কোন লোকই হিরাক্লিয়াসের মনোনীত পাদ্রী ছাড়া অন্য কোন পাদ্রীর অনুসরণ করতে পারে না। তারপর পিতা আমাকে বলেছে, তুমি ইবনে সামিরার সাথে আর দেখা সাক্ষাৎ করবে না।
ইবনে সামিরা বলল, সে যাই হোক। কিন্তু তোমার ফয়সালা কি?
উত্তরে আইনী বলল, আমার অন্য কোন ফয়সালা হতেই পারে না। আমি আন্তরিকভাবে ধর্মীয় ক্ষেত্রে কোন দল, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ে বিশ্বাসী নই। আমি আমার পিতামাতার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার চেষ্টা করব। তারা যদি না মানে তাহলে আমি তোমার নিকট চলে আসব।