তারা দেখল, অফিসারের ঘোড়াটি আগে আগে আসছে আর তার পিছনে আসছে প্রায় বিশজন সৈন্য। সবাই সশস্ত্র। যেন অভিযানে বেরিয়েছে। সৈন্যরা পল্লীটিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। অফিসার ঘোষণা করল, কোন পুরুষ ও মহিলা পলায়নের চেষ্টা করবে না। সবাই বাড়ি ছেড়ে উন্মুক্ত এই মাঠে চলে এস।
পল্লীর লোকেরা ভয় পেয়ে গেল। তারা মিসরী খ্রিস্টান। রাজকীয় খ্রিস্টান ধর্মের তারা ঘোর বিরোধী। তাছাড়া গত রাতেই তাদের গ্রামের হোরসীসের মেয়েকে নীল নদে বিসর্জন দেয়া হয়েছে। সাম্রাজ্যের আইনে তা মারাত্মক অপরাধ। তবে কি সৈন্যরা হোরসীসের মেয়ের কথা জেনে ফেলেছে?
রোমান অফিসারটি বলল, হোরসীস কে? যেই হও সামনে চলে আস। হোরসীস সামনে এগিয়ে এল। অফিসার ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়াল। অন্যান্য সৈন্যকে ঘোড়া থেকে নেমে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াতে নির্দেশ দিল।
অফিসার একটু রুক্ষ ভাষায় বলল, তুমি কি গতরাতে তোমার মেয়েকে নীল নদে উৎসর্গ করেছো?
হোরসীস সবাইকে বুঝাতে চাইল যে, সে এ সম্পর্কে কিছুই জানে না। রোমানদের কাছে সে কিছুই বলেনি। তাই বলল, না তো এমন কিছু তো ঘটেনি।
অফিসার ক্ষিপ্ত হওয়ার ভান করে বলল, আচ্ছা, তাই নাকি। তাহলে তোমার মেয়েকে নিয়ে এস। শোন, আমি জানি তোমার এক মেয়ে ছিল। আমি সন্দেহ বশে আসিনি। বিষয়টি নিশ্চিতভাবে জেনেই তবে এসেছি। যদি তুমি সত্য বলে থাক, তাহলে তোমার মেয়েকে এখানে হাজির করে সত্যতা প্রমাণ করো। আমি তোমাকে অবকাশ দিচ্ছি।
কিছুক্ষণ পরে ষোল সতের বছরের এক সুন্দরী মেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে রোমান অফিসারের সামনে দাঁড়াল। বলল, আমি তার মেয়ে। আমি বাড়িতে ছিলাম না। কিছু মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে অন্য বাড়ির ছাদের উপর থেকে দেখছিলাম যে কি হচ্ছে? এক ব্যক্তি দৌড়ে গিয়ে আমাকে বলল, আপনারা আমার পিতার উপর মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছেন যে, তিনি আমাকে নীল নদে উৎসর্গ করেছেন। তাই আমি ছুটে এলাম।
অফিসারটি মুচকি হাসল। যেন বুঝে ফেলেছে যে তার সাথে তিরস্কার করা হচ্ছে। তাকে বেকুব বানানো হচ্ছে। অফিসারটি এক ব্যক্তিকে ডেকে কাছে এনে জিজ্ঞেস করল, এই মেয়ের পিতা কে?
ভয়ভীতি ছাড়াই লোকটি বলল, হোরসীস।
অফিসারটি আরেকজন লোককে ডেকে ঐ একই কথা জিজ্ঞেস করল। লোকটি বিস্মিত কণ্ঠে বলল, আপনার কাণ্ড দেখে আমি বিস্মিত ও মর্মাহত। আপনিকি আমাদের এতোই নির্বোধ মনে করেন যে, আমরা কে কার সন্তান তাও জানি না। এ মেয়েটি হোরসীসের। ওর নাম আইনী।
তারপর অফিসার গ্রামের সকল লোককে জিজ্ঞেস করল। পল্লীর সবাই সমকণ্ঠে বলল, আমরা সবাই জানি যে এটা হোরসীসের মেয়ে।
রোমান অফিসার বুঝতে পারল না যে, এরা চোখের ইশারায় নিজেদের কর্তব্য ঠিক করে নিয়েছে। কারণ তারা যদি মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হয় তাহলে আর তাদের রক্ষা নেই, হয়তো শাস্তি স্বরূপ তাদের গোটা পল্লী আগুনে ভস্ম হতে পারে। ভয়াবহ অন্য কিছু ঘটতে পারে। তাদের অবস্থা দেখে সে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। তার মনে হল, হয়তো হোরসীস তার ব্যক্তিগত কোন আক্রোশ পূরণের জন্য তাকে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। সে ক্রোধে অধির হয়ে খপ করে হোরসীসের বাহু ধরে টানতে টানতে একদিকে নিয়ে গেল। অগ্নিঝরা কণ্ঠে বলল, তোর অন্তরে যে বদমায়েশী আছে তা বল। যদি না বিলস তাহলে এখানেই সবার সামনে তোর শির উড়িয়ে দেয়া হবে।
হোরসীস কাঁপতে কাঁপতে মৃদু কণ্ঠে বলল, হুজুর যদি আমি সত্য কথা বলি তাহলে এরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমি সত্য বলব, তবে এদের হাত থেকে আমাকে বাঁচানো আপনার দায়িত্ব।
অফিসারটি বলল, সত্য বল।
হোরসীস বলল, এ মেয়েটি তার নয়। এটা অমুকের মেয়ে। মেয়ের মায়ের নাম পর্যন্ত বলে দিল।
এ পল্লীটি নীল নদের তীরের এক জেলে পল্লী। স্থানটি বেশ উঁচু। এখানে এসেই নদীটি বাঁক নিয়েছে। তাই এখানে স্রোত খুব বেশী ও ভয়ঙ্কর। এখানে মেয়েদের নদী বক্ষে উৎসর্গ করা হয়। ফলে প্রচণ্ড ও ভয়ঙ্কর স্রোতে কেউ আর বাঁচতে পারে না।
রোমান অফিসার মেয়ের পিতা মাতাকে ডেকে আনল। জিজ্ঞেস করল, এ কার মেয়ে উভয়ে উত্তরে বলল, হোরসীসের মেয়ে। ধর্মের ব্যাপারে তারা এতো অন্ধ যে, দুচারটি কথা বলার পরই মেয়ের মা ক্ষিপ্ত হয়ে কিছু মন্দ কথা বলে ফেলল। একথাও বলল, আপনারা আমাদের অপমানিত আর অপদস্ত করার জন্যই বার বার আসেন।
অফিসারটি এবার রহস্য উন্মোচন করার জন্য নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করল। সে মেয়েটিকে ধরে নিয়ে গিয়ে নীল নদের একেবারে উঁচু তীরে দাঁড় করিয়ে দিল। দুজন সৈন্যকে নির্দেশ দিল, তারা যেন মেয়েটিকে তীর থেকে একটু দূরে দাঁড় করিয়ে তার ডান ও বাম পার্শ্বে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর সে পল্লীর লোকদের বলল, আমি এখনই এই মেয়েকে নীল নদে নিক্ষেপ করব। যদি তার মা তাকে বাঁচাতে চায় তাহলে যেন সে তাকে এসে নিয়ে যায়। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, তার মাতাপিতার বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে না। আমি তোমাদের চিন্তা করার কিছু অবকাশ দিচ্ছি। তাড়াহুড়োর কোন দরকার নেই। ভালভাবে বুঝে নাও।
মেয়েটি নীলনদের তীরে দাঁড়িয়ে আছে। তার দুপার্শ্বে দু সৈন্য। রোমান অফিসারটি পল্লীবাসীদের ও মেয়েটির মাঝে পায়চারী করছে। অফিসার তথ্য উদ্ধারে দারুণ ব্যবস্থা নিয়েছে। কারণ, কোন মাতাই সহ্য করতে পারবে না যে, তার সন্তানকে তার চোখের সামনে এ নদীর এই ভয়ঙ্কর স্রোতের মাঝে নিক্ষেপ করা হবে আর সে নির্বিচার চিত্তে তা দেখবে। আসল পিতামাতার মতো তো হোরসীস ও তার স্ত্রীর স্নেহ মায়া ও মমতা হতেই পারে না। তাই এটাই আশা করা হচ্ছিল, মেয়েটির মা ছুটে এসে তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় লুটিয়ে পড়বে। তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। কিন্তু যা ঘটল তা কেউ কল্পনায়ও কখনো ভাবেনি।