মদীনা থেকে দূর দূরান্ত এলাকায় যেখানেই হযরত ওমর (রা.)-এর পয়গাম পৌঁছেছে সেখানেই মানুষ ইসতেসকার নামাযের আয়োজন করে নামায আদায় করেছে। সবাই রোরুদ্ধ কণ্ঠে কেঁদেছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। আল্লাহর নিকট পানাহ চেয়ে প্রার্থনা করেছে।
সেদিনের সূর্যও প্রচণ্ড প্রতাপের সাথে অগ্নিবর্ষণ করতে করতে অস্তমিত হয়ে গেল। চারদিকে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু প্রকৃতিতে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। কিন্তু রাতের পর যে সকাল এল তা দেখে সবাই যেন তাদের চক্ষুকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সূর্য যেন আজ আর উদিত হচ্ছে না। মেঘে মেঘে আকাশ ছেয়ে আছে। কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে মেঘ ধেয়ে আসছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বাজ পড়ছে। সে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। মানুষ এ দৃশ্য দেখে ঘরে মসজিদে সর্বত্র আল্লাহর দরবারে সেজদায় লুটিয়ে পড়া। হু হু করে কান্না এল হৃদয় চিরে। এ কান্না বিষাদের নয়, হর্ষের। এ কান্না দুঃখের নয়, আনন্দের।
এরপর নেমে এল বৃষ্টি। মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে তো হয়েছে। থামতে যেন আর চায় না। দীর্ঘ নয় মাসের পিপাসার্ত জমিন আল্লাহর রহমতের বৃষ্টিতে পরিতৃপ্ত হয়ে গেল। মৃত গাছপালার জীবন সংগ্রাম শেষ হল। মরতে মরতে তারা বেঁচে গেল। উপত্যকা আর নিচু অঞ্চল পানিতে ভরে গেল। প্রকৃতি আবার শান্ত হয়ে গেল।
দুই তিন দিন লাগাতার বৃষ্টিপাতের পর এখন থেমে থেমে বৃষ্টি হতে লাগল। মদীনায় যে পঞ্চাশ ষাট হাজার শরণার্থী এসেছিল, প্রায় নয়মাস থেকে যারা উক্ত দস্তরখানার খাবার খেয়ে আসছে তাদের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। হযরত ওমর (রা.) এসে তাদের যার যার বাড়িতে ফিরে যাওয়ার তাকীদ দিলেন। একে একে সবাই আবার মদীনা ছেড়ে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেল। নিজ নিজ কাজে আত্মনিয়োগ করল।
***
৫. একমাত্র কন্যা
একমাত্র কন্যা। হৃদয়ের সকল সুষমা দিয়ে যাকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে। যার মায়া আর মমতা হোরসীসকে উতালা করে রাখত সেই মেয়েকে হারিয়ে হোরসীস পাগল হয়ে গেল। তার চিন্তাশক্তি যেন হঠাৎ বিকল হয়ে গেল। সে ভাবতে লাগল, এটা পাদ্রীদের কাণ্ড। তারাই ষড়যন্ত্র করে রোজীকে ছেড়ে দিয়েছে আর আমার মেয়েকে হত্যার নীল নক্সা তৈরী করেছে। পাদ্রী ও তার সহচরদের মাঝেই সকল প্যাঁচ। এরাই সকল অনিষ্টের মূল। সুতরাং এদের আর ক্ষমা করা যায় না। প্রতিশোধ এদের থেকে নিতেই হবে।
আদরের মেয়েকে হারিয়েছে, জীবনের সকল সঞ্চয় মহামূল্যবান অলঙ্কারগুলো হারিয়েছে। হোরসীস এখন প্রতিশোধ স্পৃহায় অধীর, অস্থির। ধর্মের অনুশাসনের কথা সে একেবারেই ভুলে গেল। পল্লী থেকে তিন চার মাইল দূরে রোমান সৈন্যদের একটি ক্যাম্প। সেখানে একজন সেনা অফিসার, একজন সহকারী ও বেশ কিছু সৈন্য অবস্থান করে। নীল নদের তীরে এ ধরনের বহু ক্যাম্প বিদ্যমান। এ ক্যাম্পের সৈন্যদের দায়িত্ব তারা চারদিকে টহল দিবে ও খবরাখবর রাখবে যে, নীল নদে কোন মেয়েকে বিসর্জন দেয়া হয় কি না। এ ধরনের কোন সংবাদ পেলেই তারা সেখানে ছুটে যায়। উদ্যোক্তাদের গ্রেফতার করে এনে আইনের হাতে সোপর্দ করে। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের রাজকীয় আইনে এ অপরাধ হত্যার মতই গুরুতর। কোন ক্রমেই এদের ক্ষমা করা হয় না।
হঠাৎ হোরসীসের অন্তরে সেই ক্যাম্পের কথা মনে হল। আর সাথে সাথে প্রতিশোধের আগুন যেন তার হৃদয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হোরসীস সেই ক্যাম্পের দিকে ছুটে গেল। ক্যাম্পের অফিসারকে বলল, তাদের পাদ্রী তার মেয়েকে জোর করে নিয়ে গিয়ে নীল নদে বিসর্জন দিয়েছে।
রোমান অফিসার একথা শুনে ক্ষেপে উঠল। কী! এতো বড় সাহস। আমরা জীবিত থাকতে ধর্মের নামে এ অনাচার! নির্মমভাবে মানব হত্যা! মানবতার এ কলঙ্ককে কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। সাথে সাথে সে বেরিয়ে পড়তে প্রস্তুত হল।
হোরসীসের এবার হুশ ফিরে এসেছে। ভাবল, সমাজে থাকতে হলে সামাজিক অনুশাসন মানা ছাড়া উপায় নেই। অন্যথায় সবাই তাকে বয়কট করবে। তাই সকলের উপর এই রোমান আপদ চাপিয়ে দিতে হবে। হোরসীস অফিসারকে বিনয়ের সাথে বলল, হুজুর! আপনি যদি এভাবে গিয়ে পল্লীতে তুলকামাল কাণ্ড ঘটান তাহলে পল্লীর খ্রিস্টানরা আর আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে না। হুজুর! আমাকে ওরা মেরে ফেলবে। হোরসীসের কণ্ঠে কান্নার গমক ফুটে উঠল। হোরসীস বলল, হুজুর! আমি এখন একাকী ফিরে যাই। বেশ কিছু সময় পর আপনি আসুন। আমার সাথে আপনি এমনভাবে কথা বলবেন যেন আমিও আমার মেয়ের হত্যার কাজে শামিল ছিলাম।
বুদ্ধিমানের জন্য ইংগিত যথেষ্ট। অফিসারটি সবকিছু বুঝে ফেলল এবং হোরসীসকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। হোরসীস আশা নিরাশায় দুলতে দুলতে বাড়িতে ফিরে এল এবং বিষয়টি গোপন রাখল। এমন কি তার স্ত্রীকেও বলল না।
***
দ্বিপ্রহরের পর লোকেরা দেখল, পল্লীর দিকে কয়েকটি ঘোড়া ছুটে আসছে। দূর থেকে তারা ঘোড়ার পদধ্বনি শুনতে পেল। বিশ পঁচিশটি বাড়ি নিয়ে ছোট্ট একটি পল্লী। যারা বাইরে ছিল তারা আড়ালে সরে দাঁড়াল। আর ঘরের লোকেরা উঁকি দিয়ে বাইরে তাকাল। দেখল, রোমান ক্যাম্পের সৈন্যরা আসছে। তারা প্রায়ই আসে। পল্লীর খবরাখবর নেয়। আবার চলে যায়। কিন্তু আজকে তাদের আসার ভাব দেখে সবার হৃদয় দুরুদুরু করে কেঁপে উঠল।