জনৈক সর্দার দাঁড়িয়ে বলল, আমরা অর্থ দিতে অস্বীকার করছি না। জিযিয়ার চেয়ে দ্বিগুণ অর্থ আমাদের থেকে গ্রহণ করুন তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। তবে তাকে জিযিয়া বলবেন না আর আমাদেরকে জিম্মি বলে অভিহিত করবেন না।
বেশ কিছুক্ষণ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর সিদ্ধান্ত হল যে, বনু তাগলিবের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল মদীনায় গিয়ে হযরত উমর (রা.) এর সাথে সাক্ষাৎ করবে।
তাই হল, বনু তাগলিবের প্রতিনিধি দল মদীনায় গিয়ে হযরত উমর (রা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে বলল, আমরা অর্থ দিতে প্রস্তুত। প্রয়োজনে জিযিয়ার চেয়ে দ্বিগুণ অর্থ দিতে রাজি। তবে আমাদের আবেদন, একে যেন জিযিয়া বলা না হয়। আর আমাদের যেন জিম্মি বলে অভিহিত করা না হয়। এতে আমাদের গোত্র অসম্মান বোধ করে।
হযরত উমর (রা.) অত্যন্ত দৃঢ় কণ্ঠে স্পষ্ট ভাষায় বললেন, যে জিযিয়া আরোপ করা হয়েছে আমরা তার চেয়ে বেশী নিব না। আর আমরা তাকে জিযিয়াই বলব।
বনু গলিবের এক বর্ষিয়ান সর্দার বলল, কিন্তু আমরা তাকে সদকা নামে অভিহিত করতে চাই।
হযরত উমর (রা.) বললেন, তোমরা তাকে যে নামেই অভিহিত কর কিন্তু আমরা আমাদের বিধান মতে একে জিযিয়াই বলব। …….আমি দারুণ বিস্মিত যে, তোমরা এক নিরর্থক বিষয় নিয়ে কেন এতো বাহানা করছো?
বর্ষিয়ান সর্দার বলল, আমীরুল মুমিনীন! আমরা আপনাকে আমীরুল মুমিনীন মেনে নিয়েছি। সাথে সাথে আমরা এ নিবেদন পেশ করছি, আপনি আমাদের গোত্রীয় মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করবেন। আপনি বনু তাগলিবের উঁচু মর্যাদার কথা অবহিত আছেন। আমরা জিযিয়াকে বেইজ্জতী ও অপমানজনক মনে করি। আর আশা করি, আপনি আমাদের ঐ অবদানের কথা ভুলবেন না যখন আমরা মুজাহিদ বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ইরান সম্রাট কিসরার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলাম। এখনো আমরা আবার আপনাদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করব। আমরা আপনার আনুগত্য মেনে নিয়েছি। সুতরাং আমাদের থেকে অর্থ গ্রহণ করুন। তবে আমাদের ইজ্জত ও সম্মানহানীকর কিছু করবেন না।
কিন্তু হযরত উমর (রা.) নিজ সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। কথাবার্তায় উত্তপ্তা বেড়ে চলল। তখন হযরত আলী (রা.) হযরত উমর (রা.)-কে সাআদ ইবনে মালেক নামের এক সালারের কাহিনী শোনালেন। তিনি এক অঞ্চল পদানত করার পর পরাজিত লোকদের থেকে জিযিয়া গ্রহণ না করে দ্বিগুণ সদকা গ্রহণ করেছিলেন।
তৎক্ষণাৎ হযরত উমর (রা.)-এর এ ঘটনা স্মরণ হয়ে গেল। তাছাড়া তিনি ভাবলেন, এরা যোদ্ধা। রক্ত খেলায় মেতে উঠাই এদের স্বভাব। তাই কঠোরতা অবলম্বন না করে তাদের দ্বারা কাজ নেয়াই উচিত হবে। অবশেষে ফয়সালা করা হল, তাদের থেকে দ্বিগুণ কর নেয়া হবে এবং একে সদকা নামে অভিহিত করা হবে। বনু তাগলিবের সর্দাররা সানন্দে তা মেনে নিয়ে সাথে সাথে কর পরিশোধ করে দিল। এভাবে একটা শক্তিশালী সম্প্রদায় মুসলমানদের আনুগত্য মেনে নিল। এরপর ধীরে ধীরে একের পর এক তারা ইসলামে দিক্ষীত হতে থাকল।
***
আন্তোনীস, রূতাস, লীজা ও ইউকেলিস আলেপ্পার নিকটবর্তী এক খ্রিস্টান বস্তিতে গিয়ে পৌঁছল। মরুর মাঝে কয়েকটি ঘরবাড়ি নিয়ে এ বস্তিটির অবস্থান। এরা বনু রবীয়ার লোক। আন্তোনীস ও তার সাথীদের দেখে ঘরবাড়ি থেকে লোকেরা বেরিয়ে এল। তারা বুঝতে পারল, এর রোমী। রোমীদের সম্পর্কে এদের মনে দারুণ ক্ষোভ।
আন্তোনীস ও রূতাস দীর্ঘদিন এই আরব কবিলাগুলোর মাঝে কাটিয়েছে। তাই তারা তাদের ভাষা বোঝে। তাদের ভাষায় কথা বলতে পারে। বস্তির লোকদের বলল, আমরা তোমাদের কোন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই। তারা তাদের একটি ঘরে নিয়ে গেল। ঘর থেকে একজন শীর্ণকায় বর্ষীয়ান ব্যক্তি বেরিয়ে এসে তাদের স্বাগত জানাল। সসম্মানে বসাল। বর্ষীয়ান লোকটির কথাবার্তা আচার-আচরণ অসাধারণ। তার কথা বলার ভঙ্গী, উচ্চারণ ও শব্দচয়ন থেকে সহজেই অনুমেয় যে, লোকটি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ, সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব।
লোকটি সাবলীল কণ্ঠে বলল, তোমরা কি রোমী? আমাদের অন্তরে এখন আর রোমানদের ঐ মর্যাদা নেই যা পরাজয়ের পূর্বে ছিল। তবে তোমরা আমাদের। মেহমান। ঐতিহ্য অনুযায়ী আমরা তোমাদের সমাদর করব, সম্মান করব। তোমরা কি কোথাও যাচ্ছ? তোমাদের কী সহায়তা আমরা করতে পারি? যদি পথ ভুলে এদিকে এসে থাক তাহলে আমরা পথ দেখিয়ে দিতে পারব।
আন্তোনীস বলল, জনাব! আমরা পথ ভুলে এদিকে আসিনি। আমরা আপনার গোত্রের কল্যাণে কিছু করতে চাচ্ছি। কিছু আমাদের জন্যও করতে চাই। সম্রাট হিরাক্লিয়াস পালিয়ে গেছেন। তার বাহিনী মুসলিম মুজাহিদদের হাতে নিঃশেষ হয়ে গেছে। যারা পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে তারাও বিক্ষিপ্ত। তাদের কোন সংগঠিত অস্তিত্ব নেই। আমি রোমান বাহিনীর একজন সালার। সেও একজন সালার। এই মহিলা আর যুবকটি কে তা পরে বলব। আমরা এখন বলতে চাচ্ছি, আমাদেরকে রোমান মনে করবেন না। আমরা একই ধর্মের অনুসারী পরস্পরে ভাই। সম্রাট হিরাক্লিয়াস প্রথমে বাদশাহ, তারপর খ্রিস্টান। তার ধার্মিকতা কপটতার মুখোশ মাত্র। আর আমরা প্রথমে খ্রিস্টান, তারপর। রোমান।
তারপর আন্তোনীস ঐ ক্রুশটি দেখান যা রূতাসকে সিপাহসালার আবু উবায়দা (রা.) দিয়েছিলেন এবং বলল, আমরা এই পিতার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় জীবন বাজি রাখতে চাচ্ছি।