একদিন হযরত ওমর (রা.) মদীনা থেকে একটু দূরে এক পল্লী দিয়ে আসছিলেন। হঠাৎ তার কানে স্বজন হারানোর কান্নার আওয়াজ এল। এক মহিলার যুবক পুত্র এবং আরেক মহিলার স্বামী মারা গেছে। হযরত ওমর (রা.) গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এরা তো অনাহারে মারা যায়নি? উত্তর পেলেন যে, না তারা অনাহারে মারা যায়নি। হযরত ওমর (রা.)-এর হৃদয় কিছুটা শান্ত্বনা খুঁজে পেল। শুনলেন, এক অজ্ঞাত রোগের কারণে তারা মারা গেছে যা তারা বুঝতেও পারেনি।
সাথে সাথে হযরত ওমর (রা.) বাইতুল মাল থেকে তাদের কাফনের ব্যবস্থা করলেন। নিজেই তাদের জানাযার নামায পড়ালেন ও দাফনের ব্যবস্থা করলেন।
দেখতে দেখতে এ অজানা রোগ চারদিকে ছড়িয়ে গেল। রোগাক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসারও কোন সময় পাওয়া যায় না। এ রোগ মহামারী আকার ধারণ করল। আমীরুল মুমিনীনের শান্তি দূর হয়ে গেল। একটু আধটু যাও বিশ্রাম নিতেন তাও এখন শেষ হয়ে গেল। গ্রামের পর গ্রাম, পল্লীর পর পল্লীতে তিনি ছুটতে লাগলেন। চিৎিসকদের চিন্তার শেষ নেই। তাদের ঔষধ কোন কাজে আসছে না। ঔষধ প্রয়োগে রোগী সাথে সাথে মারা না গেলেও কয়েকদিন মাত্র বেঁচে থাকে।
চিকিৎসকদের ধারণা, দীর্ঘ খরা, প্রচণ্ড তাপদগ্ধতা আর উত্তপ্ত বায়ু প্রবাহের কারণে এ মহামারী দেখা দিয়েছে। হযরত ওমর (রা.) হুকুম দিলেন, এ রোগে। আক্রান্ত হয়ে যারা ইন্তেকাল করবে তাদের কাফন দাফনের ব্যবস্থা বাইতুল। মালের পক্ষ থেকে করা হবে। সম্ভাব্য সকল জায়গায় গিয়ে হযরত ওমর (রা.) মৃতদের জানাযার নামায পড়াতেন ও দাফনে শরীক হতেন।
হযরত ওমর (রা.) জানাযার নামাযে গেলে এখন কারো কারো কাছ থেকে শুনতে লাগলেন, হে আমীরুল মুমিনীন! ক্ষুধার হাত থেকে তো আমরা বাঁচলাম। কিন্তু এখন এ মহামারী থেকে বাঁচার উপায় কি? অথবা কেউ হয়তো বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! রুটির ব্যবস্থা তো আপনি করেছেন, কিন্তু এখন বাঁচবো কোন উপায়ে?
অজ্ঞাত এ রোগের কারণে গোটা আরবে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। এর আগে হযরত ওমর (রা.) প্রত্যেক নামাযের পর দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচার দুআ করতেন। এ অজ্ঞাত রোগ আক্রমণ করার পর থেকে তিনি রাতের ঘুম ছেড়ে দিলেন। সারারাত নামায পড়েন আর বিনয় বিগলিত নেত্রে আল্লাহর নিকট দুআ করেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শিশুর ন্যায় কাঁদেন আর বলেন, হে আল্লাহ! হে দয়াময় খোদা! হে গাফুরুর রাহীম! আমার পাপের শাস্তি আপনি আপনার রাসূলের উম্মতেদের দিয়েন না। হে আল্লাহ! আমাদের ক্ষমা করে দিন। আমাদের এই বিপদ থেকে মুক্তি দিন। কিন্তু আকাশ যেন বন্ধ হয়ে গেছে। দুআ যেন আল্লাহর দরবারে পৌঁছছে না।
***
অবশেষে আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.) একেবারে নিরূপায় হয়ে গেলেন। সকল প্রচেষ্টা তার ব্যর্থ হয়ে গেল। মৃত্যুর হাত থেকে তিনি আর কাউকে বাঁচাতে পারছেন না। এ মহামারী যেন আরবকে মানবমুক্ত করে ছাড়বে।
তিনি চারদিকে এ পয়গাম দিয়ে পাঠালেন, যেন সকল অঞ্চলের লোক নিজ নিজ অঞ্চলে একত্রিত হয়ে ইসতেসকার নামায পড়ে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর নিকট দুআ করে যেন আল্লাহ্ আমাদের এ মহা আযাব থেকে মুক্তি দান করেন। আর যারা রাতেই মদীনায় এসে পৌঁছতে পারে তারা যেন মদীনায় চলে আসে।
দূতরা সাথে সাথে রওয়ানা হয়ে গেল। দূর দূরান্তের দূতরা রাতেও বিরামহীন গতিতে চলতে লাগল। পরদিন দুপুরে মদীনায় ইসতেস্কার নামাযের সময় নির্ধারণ করা হল। প্রত্যেক অঞ্চলের লোক সময় নির্ধারণ করে ইতেকার নামাযের আয়োজন করল।
পরদিন দুপুরে মদীনার লোকেরা, শরণার্থীরা ও নবাগত লোকেরা মদীনার বাইরে এক বিশাল চত্বরে সমবেত হল। প্রায় পঞ্চাশ ষাট হাজার মানুষ দুপুরের অগ্নিঝরা রোদে সারিবদ্ধভাবে নামাযের জন্য দাঁড়িয়ে গেল। মাটি যেন জ্বলন্ত কয়লা। তাতে খালি পা রাখার কথা চিন্তা করাই যায় না। কিন্তু আমীরুল মুমিনীনের নির্দেশে সবাই এসে সমবেত হল। হযরত ওমর (রা.) নামায পড়ানোর জন্য সামনে অগ্রসর হলেন। তার শরীরে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইতি ওয়াসাল্লামের ব্যবহৃত চাদর। নামায শুরু হতে না হতেই চারদিকে কান্নার আওয়াজ উত্থিত হল। সবাই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। হাজার হাজার নিরূপায় অক্ষম মানুষ আল্লাহর সামনে তাদের নিবেদন পেশ করছে, ক্ষমা ভিক্ষা চাচ্ছে। আযাব থেকে মুক্তি চাচ্ছে। হযরত ওমর (রা.)ও নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। নামাযের শেষ পর্যন্ত তিনি কাঁদতেই থাকলেন।
নামাযের পর হযরত ওমর (রা.) দুআ শুরু করলেন। কিন্তু কান্নার কারণে তার কোন কথাই বুঝা গেল না। অবুঝ শিশুর মত তিনি দীর্ঘক্ষণ কাদলেন। তার। দাড়ি মোবারক বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরল। হযরত আব্বাস (রা.) হযরত ওমর (রা.)-এর সামনে বসা ছিলেন। দুআ চলাকালীন অবস্থায়ই তিনি আব্বাস (রা.)-এর বাহু ধরে কাছে টেনে আনলেন এবং তার দুহাত দুআ করার ন্যায় তুলে ধরলেন ও বললেন, হে আল্লাহ! আমরা আপনার রাসূলের চাচাকে আপনার নিকট সুপারিশ হিসাবে উপস্থিত করছি। হে আল্লাহ্! আপনি তার দুআ কবুল করে আমাদের এ বিপদ থেকে উদ্ধার করুন। আমাদের বাঁচান।
হযরত আব্বাস (রা.) হযরত ওমর (রা.)-এর চেয়ে উচ্চ কণ্ঠে বললেন, হে পরওয়ার দেগার! আপনার রাসূলের উছিলায় আমাদের উপর রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করুন। প্রবল আবেগ ও কান্নার মাঝে হযরত আব্বাস (রা.)-এর কণ্ঠ হারিয়ে গেল।