পেরেশানীর পর পেরেশানী, কষ্টের পর কষ্টের প্রভাব তার শরীরে দেখা দিল। তাছাড়া দৈনন্দিনের খাবারও তিনি কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে লাগল। রক্তশূন্য হয়ে শরীর ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ক্রমেই শরীর শুকিয়ে যেতে লাগল। মাঝে মাঝে পেটে ব্যথা অনুভব করতে লাগলেন। তার সঙ্গীরা ও ঘনিষ্ট লোকেরা তাকে নিয়ে দারুণ পেরেশানীতে পড়ে গেল। যদি তিনি রীতিমত প্রয়োজনীয় খাবার গ্রহণ না করেন তাহলে তো তিনি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবেন।
বর্ষীয়ান গণ্যমান্য সাহাবীদের কয়েকজন তাঁকে বললেন, আপনি বিশ্রাম করেন না বা না করেন সে ব্যাপারে আমরা আপনাকে কিছু বলব না, কিন্তু প্রত্যেক দিনের পরিমাণ মত খাবারটুকু তো আপনি গ্রহণ করবেন।
আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.) তাদের কথা সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করতে পারলেন না। বললেন, মানুষের কষ্টের অনুভূতি আমি এভাবেই অনুভব করি। সুতরাং আমার অবস্থা নিয়ে আপনারা চিন্তা করবেন না।
এদিকে হযরত ওমর (রা.) সময় পেলেই ছুটে গিয়ে জায়নামাজে দাঁড়ান। আল্লাহর দরবারে লুটিয়ে পড়েন। নামায আদায় করেন। তারপর এক সকরুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়। দুহাত প্রসারিত করে কাঁদতে থাকেন। অবিরাম অশ্রু ঝরতে থাকে তার চোখ থেকে। কেঁদে কেঁদে বলেন, হে আল্লাহ্! যদি এ মহা দুর্ভিক্ষ আমার পাপের কারণে হয়ে থাকে তাহলে তার শাস্তি আমাকে দিন। আমার জাতিকে দিবেন না।
এতো কাঁদছেন, এতো দুআ করছেন, কিন্তু দুআ কবুল হচ্ছে না। আকাশে কোন মেঘের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। সূর্য আগুনের হলকা বর্ষণ করে চলছে। পৃথিবী জ্বলে পুড়ে তামা হয়ে যাচ্ছে।
***
আকাশ যেন আরবদের বৈরী হয়ে গেছে। আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.)-এর সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা, তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা ও দেখা শোনাতে মানুষ অনাহার আর ক্ষুধার জ্বালা থেকে রক্ষা পেলেও দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা পেল না। পরিবেশের উত্তাপ ক্রমেই বেড় চলল। সূর্যও নির্মমভাবে অগ্নি বর্ষণ করতে থাকল। বাতাসের গায়ে শুধু আগুনের হলকা।
এদিকে হযরত ওমর (রা.)-এর শরীর ক্রমেই ভেঙে পড়ছে। এতে সাহাবায়ে কেরাম দারুণ চিন্তিত, অত্যন্ত পেরেশান। কারণ তিনি পুষ্টিকর খাবার একেবারেই ছেড়ে দিয়েছেন। ঘি, গোশত এ ধরনের খাবারে হাত পর্যন্ত দেন না। তিনি বলেন, আরবের প্রতিটি লোক যখন এ ধরনের খাবার খেতে পারবে তখনই আমি এ ধরনের খাবার খাব।
একদিন এক ঘটনা ঘটল। হযরত ওমর (রা.) এর কিছু অন্তরঙ্গ লোক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন যে, তাঁকে আজ কিছু ভাল খাবার অবশ্যই খাওয়াবেন। তারা তাকে সাধারণ দস্তরখানা থেকে সরিয়ে একটু দূরে বসালেন। গোশতের সাথে ঘিয়ে ভাজা রুটি তাকে দেয়া হল। তারা বিভিন্ন কথায় মশগুল হয়ে পড়ল। তাদের ধারণা, হয়তো কথার তালে তালে হযরত ওমর (রা.) কি খাচ্ছেন সেদিকে কোন খেয়াল করবেন না। বেখেয়ালে গোশত দিয়ে ঘিয়ে ভাজা রুটি খেয়ে ফেলবেন। কিন্তু হযরত ওমর (রা.) দারুণ সচেতন। তিনি কাউকে কিছু বললেন না। হাত দিয়ে খাবারগুলো সরিয়ে রাখলেন। তারপর শান্ত কণ্ঠে বললেন, ভাইয়েরা! যাও, দস্তরখানায় ঘুরে ঘুরে দেখ। যে ব্যক্তি অনাহারে অর্ধাহারে একেবার শীর্ণকায় হয়ে গেছে তাকে এ খাবার দিয়ে দাও। আমার তো সাধারণ রুটি আর সামান্য তরকারীই যথেষ্ট।
সেদিন সন্ধ্যায় হযরত ওমর (রা.) নির্দেশ দিলেন, যারা সাধারণ দস্তরখানায় খাবার খায় তাদের সংখ্যা গণনা করা হোক। গণনা করে দেখা গেল, সাত হাজারের চেয়ে কিছু বেশী লোক সাধারণ দস্তরখানায় বসে আহার খায়। আর বৃদ্ধ, অসুস্থ, নারী ও শিশুরা যারা দস্তরখানায় উপস্থিত হয় না এবং তাদের খাবার তাদের নিকট পৌঁছে দেয়া হয় তাদের সংখ্যা চল্লিশ হাজারেরও বেশী।
সে রাতেও আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.) সাধারণ মানুষের সাথে বসে সাধারণ খাবার খেলেন। তিনি পানি চাইলে মধু মিশ্রিত পানি তাকে দেয়া হল। এক ঢোক পানি পান করেই তা ফিরিয়ে দিলেন। বললেন, আল্লাহর কসম করে বলছি, আমি এমন কাজ করব না কিয়ামত দিবসে যার জওয়াব দিতে হবে।
আরেক দিনের ঘটনা। হযরত ওমর (রা.) দেখলেন, তার এক ছোট্ট ছেলে একটুকরো তরমুজ খাচ্ছে। সাথে সাথে তার চেহারার রং পাল্টে গেল। কণ্ঠস্বর কঠোর হয়ে গেল। বললেন, বাহবা, দেখ দেখ আমীরুল মুমিনীনের ছেলে ফল খাচ্ছে আর রাসূলের উম্মতরা অনাহারে মরছে!
পুত্র তার পিতার কঠোর স্বভাব জানত। ভয়ে সে কেঁদে ফেলল। এতেই হযরত উমরের ক্রোধ শান্ত হল না। তখন জনৈক ব্যক্তি এগিয়ে এসে বলল, ছেলেটি কয়েকটি খেজুর দিয়ে তার বিনিয়ে তরমুজের এই টুকরাটি নিয়েছে। এবার হযরত ওমর (রা.)-এর ক্রোধ শান্ত হতে শুরু করল। ধীরে ধীরে তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেন।
***
দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা বেড়েই চলল। প্রকৃতির রুক্ষ্মতা যেন আর শেষ হয় না। ইরাক আর শাম থেকে কাফেলার পর কাফেলা আসছে। খাদ্যে বোঝাই উট আসছে। সুশৃঙ্খলতার সাথে খাদ্য বণ্টন হচ্ছে। মদীনা, তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ও দূর দূরান্তে তা বিতরণ করা হচ্ছে। আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.) নিজে তার তদারকী করছেন। দেখাশোনা করছেন। দেখতে দেখতে ছয় সাত মাস কেটে গেল।