***
আকাশ পরিষ্কার। মেঘের কোন চিহ্ন নেই। ক্ষীপ্ত সূর্য পৃথিবীতে শুধু আগুন আর আগুন ঝরাচ্ছে। জমি-জমার মাটি শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। আবহাওয়া প্রতিকূল দেখে কৃষকরা জমিনে চাষ করা বন্ধ করে দিয়েছে। চারদিকে যেন আগুন আর আগুন। জমিনের সকল ঘাস পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। শাক-সবজি যা কিছু মাটির উপর ছিল তা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
খেজুর বাগানের অবস্থা আরো করুণ। খেজুর গাছে কাঁদির কোন নাম। নিশানা নেই। স্তবকের কোন চিহ্ন নেই। বাগানে সবুজের কোন আলামত নেই। পাতাগুলো শুকিয়ে শুকিয়ে মরে গেছে। কচি কোন পাতা দেখা যায় না। শুকনো কাঠির মত গাছগুলো দাঁড়িয়ে যেন বাঁচার জন্য নিরবে আর্তনাদ করছে। গরু, বকরী, মহিষ আর মেষগুলো দিনে দিনে মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অনাহারে মানুষও মরতে শুরু করেছে। যারা ধন-সম্পদশালী তারাও ভীষণ কষ্টে আছে। কারণ বাজারে খাদ্যই নেই; কিনবে কোথা থেকে। সম্পদের জায়গায় সম্পদ পড়ে রইল। আর অনাহারে সম্পদশালীরা মরতে লাগল।
ইরাক, শাম আর ফিলিস্তিন থেকে যে খাদ্যের কাফেলা এসেছে হযরত ওমর (রা.) সেইসব কাফেলার লোকদের নির্দেশ দিলেন, তারা যেন দুর্দশাগ্রস্থ, ক্ষুধা-আক্রান্ত এলাকায় গিয়ে তা বণ্টন করে দেয়। তিনি নির্দেশ দিলেন, কাফেলার উটগুলোকে যবাই করে তার গোশত বিতরণ করে দিবে। কারণ দুর্ভিক্ষ কবলিত অঞ্চলে একটি উটও জীবিত নেই। সব মরে গেছে। যদিও দুএকটি বেঁচে থাকে তাহলে তা হাড়ের খাঁচা। গোশতের তাতে কোন নাম নিশানা নেই। কাফেলাগুলোর সাথে প্রায় দশ হাজার উট এসেছিল। সবগুলো উট যবাই করে ক্ষুধাপীড়িত মানুষের মাঝে বিতরণ করা হল।
ইসলামী খেলাফতের প্রাণকেন্দ্র মদীনা নগরী। এ নগরীতে খলীফা বসবাস করেন। খলীফার সহকর্মী পরামর্শদাতা সাহাবায়ে কেরাম বসবাস করেন। এ শহরে রয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের সমাধী। তাই এ নগরী গোটা আরবের প্রাণকেন্দ্র। গোটা ইসলামী জাহানের হৃদপিণ্ড।
দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষেরা অনন্যোপায় হয়ে দলে দলে মদীনায় এসে আশ্রয় নিতে লাগল। তাদের চোখে মুখে একটু আশা একটু ভরসা, হয়তো মদীনায় গেলে একমুঠো খাবার মিলবে। ছেলেপুলে নিয়ে জীবনটা ধরে রাখা সম্ভব হবে।
হযরত উমর (রা.) মদীনাবাসীদের নির্দেশ দিলেন, তারা যেন প্রতিদিন দ্বিগুণ খাবার তৈরী করে। এবং আশ্রিত ব্যক্তিদের খাবার দান করে। মদীনার লোকেরা অম্লান বদনে তা মেনে নিল। এভাবে কয়েকদিন চলল। কিন্তু শরণার্থীদের সংখ্যা প্রত্যেক বেলায়ই বেড়ে চলছে। হযরত উমর (রা.) অস্থির বেকারার। সারাক্ষণ ঘুরে ঘুরে মানুষের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। মানুষের খোঁজ খবর নেন। মদীনার লোকদের যথাসাধ্য চেষ্টা সত্ত্বেও শরণার্থীদের বেশ কিছু লোক ক্ষুধার্ত থেকে যেতে লাগল।
আবার চিন্তিত হয়ে পড়লেন হযরত উমর (রা.)। কী করবেন। কী ব্যবস্থা নিবেন। অস্থির ভাবে পায়চারী করতে করতে হঠাৎ তার মাথায় এক নতুন চিন্তা এল। ব্যস্ আর দেরি করলেন না। মদীনার লোকদের জানিয়ে দিলেন, এখন থেকে আর কেউ নিজ নিজ ঘরে আলাদাভাবে খাবার তৈরী করবে না। সবার খাদ্য এক স্থানে জমা করে সম্মিলিতভাবে তৈরী করা হবে। সবাই একই দস্তরখানে বসে খাবার খাবে। আমীরুল মুমিনীন নিজ ঘর থেকে তা শুরু করলেন। মদীনা নগরীর খাবার এক জায়গায় তৈরী হতে লাগল। সবাই একই দস্তরখানায় বসে খেতে আরম্ভ করল। আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর (রা.)-এর ঘরেও পাক বন্ধ হয়ে গেল। তিনি তার পরিজনদের নিয়ে সবার সাথে সম্মিলিত দস্তরখানায় খাওয়া দাওয়া শুরু করলেন।
প্রত্যেক দিন দুবেলা সম্মিলিত খাবারের আয়োজন হয়। প্রত্যেক বেলা দশ হাজরের চেয়ে বেশী লোক এ সম্মিলিত দস্তরখানায় বসে আহার গ্রহণ করে। যারা অসুস্থ, বৃদ্ধ, যাতায়াতে অক্ষম, তাদের খাবার পৌঁছে দেয়া হয়। নারী ও শিশুদের খাবারও পৌঁছে দেয়া হয়। এদের সংখ্যাও পঞ্চাশ হাজারের কম হবে না।
আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর (রা.) সবার সাথে বসে সম্মিলিত দস্তরখানায় খাবার খান। একদিন হযরত ওমর (রা.) খেতে বসলেন। ঘটনাক্রমে তার সাথে এক বেদুইন একই পাত্রে খেতে বসেছে। সেদিন রুটি আর ঘি পরিবেশন করা হয়েছিল। বেদুইন হযরত ওমর (রা.)-এর সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ শুরু করল। লোকটি বেশী বেশী ঘি নিয়ে বড় বড় লোকমরা দিয়ে খাওয়া শুরু করল। হযরত ওমর (রা.) বেদুইনের এ কাণ্ড দেখে বিস্মিত হলেন। বললেন, ভাই! তুমি কি ঘি দিয়ে রুটি খাওনি?
বেদুইন বিষয়টি বুঝতে না পেরে হেড়ে গলায় বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! দুর্ভিক্ষ আসার পর থেকে ঘি দেখিনি, রুটিও দেখিনি। তাই ঘি আর রুটি ইচ্ছামত খেয়ে নিচ্ছি।
একথা শুনে আমীরুল মুমিনীনের চোখ অশ্রুসজল হয়ে গেল। তিনি কসম করে বললেন, যতদিন পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ শেষ না হবে ততদিন আমি আর ঘি ও রুটি দ্বারা খাবার গ্রহণ করব না। এরপর তার মনে আরো ভাঙন সৃষ্টি হল। সবাই দেখতে লাগল, হযরত ওমর (রা.) গোশত খাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছেন। তার অবস্থা এমন হল যে, সারাক্ষণ শরণার্থীদের অবস্থা দেখছেন। যারা মদীনার বাইরে দূরে দূরে আছে তাদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। প্রয়োজনে গিয়ে তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আসছেন। জিজ্ঞেস করছেন, তাদের নিকট নিয়মিত খাবার পৌঁছছে কি না?