গম্ভীর কণ্ঠে বিন ইয়ামীন বলল, আমি এ প্রথাকে ভাল মনে করি না। এটা একটা মনগড়া প্রথা। আমাদের লোকেরা এটাকে পাপ কাজ মনে করে। কিন্তু এখন এটা নিয়ে ফাসাদ করার সময় নয়। যারা যুবতীদের বিসর্জন দেয় তারা আমাকে আধ্যাত্মিক নেতা হিসাবে মানে। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে আমরা যে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি তার পক্ষে তারা অম্লান বদনে সব কষ্ট সহ্য করে যাচ্ছে। যদি আমি তাদের ঐ প্রথার বিরুদ্ধে কিছু বলি তাহলে কট্টরপন্থী লোকেরা আর মূর্খ লোকেরা আমাকে ত্যাগ করবে। ফলে আমাদের শক্তি খর্ব হয়ে যাবে। আমরা রাজকীয় খ্রিস্ট ধর্মের কাছে পরাজিত হয়ে যাব। আচ্ছা যাক সে কথা, এখন তোমরা যে জন্য এসেছো সে কথা বল।
দলপতি বলল, আমরা তো আমাদের কথা শেষ করে ফেলেছি। আমরা এখন আপনার উত্তরের আশায় আছি। আমরা তা পেলেই আমাদের সর্দারদের নিকট তা পৌঁছাব।
বিন ইয়ামীন হাসতে হাসতে বলল, তোমাদের সর্দারদের নিকট নয়, বরং তোমাদের সালার আমর ইবনে আসের নিকট পৌঁছাবে। তোমরা এতো বেশী কথা বলেছো যে তোমরা নিজেদের উপর যে আবরণ দিয়েছিলে আমি তা উঘাটন করতে পেরেছি এবং তোমাদের আসল রূপ আমার নিকট পরিষ্কার হয়ে গেছে। এই মেয়েটিকে দেখে আমি বুঝে উঠতে পারছি না, তোমরা তাকে কেন লড়াইয়ের ময়দানে নিয়ে এসেছো। মুসলমানরা তো যুদ্ধ ময়দানে নারীদের আনে না। এবং গুপ্তচর বৃত্তিতেও নারীদের নিয়োগ করে না। কিন্তু তোমরা এটা করলে কী!
রাবেয়া বলল, আমি নও মুসলিম। গতকাল মুসলমান হয়েছি। আমি শামের আলেপ্পা শহরের অধিবাসী। রাবেয়া তার মনের কথা বলে দিল। কিছু কমালোও না, কিছু বাড়ালও না। তারপর বলল, এ মুসলমানরা তাদের দায়িত্ব থেকে কিছুটা সরে এসে আমাকে নতুন জিন্দেগী দান করেছে। আমি তাদের কাজকর্মে এতো প্রভাবিত হয়েছি যে, সাগ্রহে মুসলমান হয়ে গেছি। তারা আমাকে বিশ্বস্ত মনে করে তাদের সাথী করে নিয়েছে।
ওয়াইস বলল, আর আমিও নও মুসলিম। আমি আমার জীবনকে ইসলামের সেবার জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছি। তারপর ওয়াইস তার ইসলাম গ্রহণের কাহিনী বর্ণনা করল।
বিন ইয়ামীন অত্যন্ত দূরদর্শী, বিচক্ষণ ও চৌকস। ভবিষ্যতে কি ঘটতে পারে লক্ষণ দেখে তা সে অনুমান করতে পারে। মনে হয় আকাশ বাতাস, চাঁদের কিরণ আর সূর্যের আলো তাকে কানে কানে সবকিছু বলে দেয়। সে বেশ কিছুক্ষণ নিরব রইল। কোন কথা বলল না। তারপর ধীরে ধীরে তার মাথা দুলে উঠল। ভেবে চিন্তে যেন কোন কঠিন বিষয়ের সমাধানে পৌঁছতে পারল। বলল, আমি দিব্য দৃষ্টিতে ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। মুসলমানরা যদি তাদের বর্তমান আদর্শ ধরে রাখতে পারেন তাহলে খ্রিস্টানরা ধীরে ধীরে ইসলাম ধর্শ গ্রহণ করতে থাকবে। এক সময় মিসর হবে ইসলামী দেশ। রোমানরা মিসরে থাকতে পারবে না। মিসর ছেড়ে তাদের যেতেই হবে। মুসলমানরা যদি মিসর আক্রমণ করে তাহলে মিসরের খ্রিস্টানরা নিরব দর্শকের ন্যায় তামাশা দেখতে থাকবে। আর এটা কোন আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, রোমানরা খ্রিস্টান হওয়া সত্ত্বেও মিসরের খ্রিস্টানরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। বরং মুসলমানদেরকেই তারা স্বাগতম জানাবে।
তোমরা ফিরে যাও। রোমানদের বিরুদ্ধে মিসরের খ্রিস্টানদের উসকে দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। আমরা রোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চাই না। আমাদের সে অস্ত্র ও জনবল নেই। আমরা রোমানদের এই ধোকায় ফেলে রাখব যে, আমরা তাদের ওফাদারও হিতাকাঙ্ক্ষী প্রজা। আমরা তাদের বিশ্বস্ত শুভানুধ্যায়ী গোলাম।
***
মুসলিম গুপ্তচরদের মিশন সফল হল। মিসরের অন্য কোন অঞ্চলে গিয়ে খ্রিস্টানদেরকে রোমানদের বিরুদ্ধে উসকে দেয়ার বা বিদ্রোহ করানোর প্রয়োজন অনুভব করল না। খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় নেতা তাদের সে প্রয়োজন পূরণ করে দিয়েছে। ওয়াইস একটু বেশী সফল হল। তারা বিন ইয়ামীন থেকে বিদায় নিয়ে কাউস এলাকায় এসে পৌঁছল এবং সেখানেই রাত কাটাল।
খুব ভোরে যখন দুএকটি কাক কা কা করে উঠেছে তখন তারা ভাড়া করা উটে করে ইস্কান্দারিয়ায় রওয়ানা হয়ে গেল। তারা আশঙ্কা করছিল, যদি কেউ রাবেয়াকে চিনতে পারে তাহলে মহাবিপদ হবে। তাকে ছিনিয়ে নিয়ে আবার নীল নদে নিক্ষেপ করবে। ভাগ্য প্রসন্নই বলতে হয়। বন্দরে পৌঁছার সাথে সাথেই তারা একটি জাহাজ পেয়ে গেল।
তারা মিসর থেকে ফিরে এসে শুনল, সিপাহ সালার আমর ইবনে আস (রা.) বাইতুল মুকাদ্দাসে আছেন। তারা বন্দর থেকে বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে রওয়ানা হয়ে গেল। আমর ইবনে আস (রা.) যখন শুনতে পেলেন যে, মিসরে প্রেরিত গুপ্তচর তিনজন ফিরে এসেছে, তারা আপনার সাক্ষাৎ প্রার্থী। সাথে সাথে তিনি তাদের ডেকে পাঠালেন।
সিপাহসালার তাদের জিজ্ঞেস করলেন, কি করে এলে?
দলপতি তখন মিসরের কার্যাবলী একে একে উপস্থাপন করল এবং পাদ্রী নেতা বিন ইয়ামীনের কথা হুবহু শোনাল।
তারপর দলপতি বলল, এটা তো পাদ্রী বিন ইয়ামীনের কথা। তাছাড়া আমরাও মিসরের সব শ্রেণীর মানুষের সাথে কথাবার্তা বলেছি। গির্জায়, সরাইখানায়, হাটে-বাজারে, শহরে-বন্দরে, সবার সাথে রোমানদের ব্যাপারে আলোচনা করেছি। দেখেছি, তারা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, অতিষ্ঠ।
আমর ইবনে আস (রা.) বললেন, বিন ইয়ামীন যা বলে দিয়েছে তাই শেষ কথা। এরপর আর কিছু বলার থাকে না।