***
বিন ইয়ামীন আত্মগোপন করে আছে। অত্যন্ত সর্তক অবস্থায় আছে। তাই তার ঠিকানা নেয়া, আর আস্তানা খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন ওদুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু তারা গুপ্তচর। বার বাজারের তের গলিতে তাদের যাতায়াত। সকল রহস্যের গ্রন্থি উন্মোচন করাই তাদের কাজ। তাই বিন ইয়ামীন কোথায় আছে তা বের করতে তাদের বেগ পেতে হল না। বিন ইয়ামীনের আস্তানা খুব বেশী দূরে নয়। তবে অত্যন্ত দুর্গম। চড়াই উত্রাই আর ঘন বনজঙ্গল পেরিয়ে তবে আস্তানায় পৌঁছতে হয়।
দ্বিপ্রহরের পর তারা সেখানে গিয়ে পৌঁছল। ছোট্ট একটি খেজুরের বাগান। চারদিকে রালিয়াড়ির মাঝে বাগানটিকে মরুদ্যান মনে হয়। একটি ছোট গির্জা। তার চার পাশে কয়েকটি তাঁবু। পাথরের তৈরী গির্জার এক কোণে একটি কামরায় বিন ইয়ামীন থাকে। তাকে সংবাদ জানান হল, তিনজন পুরুষ ও একজন মহিলা আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছে। বিন ইয়ামীন তাদের ডেকে পাঠালেন।
মুজাহিদদের দলপতি তাদের পরিচয় দিয়ে বলল, আমরা আলোর অধিবাসী। খ্রিস্টান। আর এ মেয়েটি আমাদের এই বন্ধুর স্ত্রী। কিছুদিন পূর্বে তাদের বিয়ে হয়েছে। তার স্ত্রী মিসর দেখার জন্য ও আপনার সাথে সাক্ষাৎ করে আশির্বাদ নেয়ার জন্য একেবারে কাতর হয়ে গিয়েছিল, তাই তাকেও সাথে করে এনেছি। সবার গলায় তখন ক্রুশ শোভা পাচ্ছিল। খ্রিস্টানদের নামের মতই তারা তাদের নাম বলল।
বিন ইয়ামীন বলল, তোমরা কি শুধু আমার সাথে সাক্ষাৎ করতেই এসেছ না বলার কোন কথা আছে? শামে খ্রিস্টানরা কি অবস্থায় আছে?
দলপতি বলল, আমরা শুধু আপনার সাক্ষাতের জন্যই এসেছি। তবে আমাদের একটি কথা আছে। শামে রোমানরা খ্রিস্টানদের সাথে গাদ্দারী করেছে। প্রতারণা করেছে। আমরা ত্রিশ হাজার সৈন্য সশস্ত্র অবস্থায় সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নিকট গেলাম। বললাম, আমরা রোমান সৈন্যদের সাথে মিশে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। কিন্তু সম্রাট হিরাক্লিয়াস ও তার ছেলে কুস্তুনতীন আমাদের সাথে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করল। সর্বশেষে যুদ্ধের ময়দানে আমাদেরকে মুসলমানদের তরবারীর নিচে ফেলে পালিয়ে গেল।
এতটুকুতেই তাদের মনের আশা মিটল না। তারা আমাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উত্সকে দিল। আমরা বিদ্রোহ করলাম। কিন্তু তারা আমাদের সহায়তায় এগিয়ে এল না। আমরা মুসলমানদের মুকাবিলা করতে পারলাম না। অস্ত্র সমর্পণ করলাম। মুসলমানরা আমাদের নির্বিচারে হত্যা করতে পারত। তারা ইচ্ছে করলে আমাদের মেয়েদের ও স্ত্রীদের বাদী বানাতে পারত। আমাদের সন্তানদের গোলাম বানাতে পারত। কেউ তাদের বাধা দেয়ার ছিল না। কিন্তু তারা তা করল না, এমন কি তারা নির্যাতনমূলক কোন কাজও করল না। তারা বিজয়ী আর আমরা পরাজিত। তারা শাসক আর আমরা শাসিত–এমন আচরণ ও তাদের থেকে প্রকাশ পেল না। এমন কি তারা আমাদের ধর্মের ব্যাপারেও কিছু বলল না। কোন হস্তক্ষেপও করল না।
বিন ইয়ামীন বলল, আমি রোমানদের কার্যাবলী সম্পর্কে সজাগ। সবকিছুই জানি। শামে তারা তাদের কৃতকর্মের ফল পেয়েছে। কিন্তু তাদের শিক্ষা হয়নি। মিসরেও তারা তাই শুরু করেছে। রাজকীয় খ্রিস্ট ধর্মের নামে বর্বর ও নির্মম অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। তোমরা তো শুনেছো যে, আমি আত্মগোপন করে আছি। এমন অবস্থায় আমি শামের খ্রিস্টানদের জন্য কি করতে পারি?
দলপতি বলল, আমরা আপনার থেকে সাহায্য নেয়ার জন্য আসিনি। আমরা মিসরের খ্রিস্টানদের সহায়তা করতে এসেছি।
বিন ইয়ামীনের কণ্ঠে বিস্ময়ভাব ফুটে উঠল। বলল, তোমরা আমাদের কি সাহায্য করতে পারবে?
দলপতি বলল, আমাদের সর্দাররা আর পাদ্রীরা মিসরের সব খবর জানে। মিসর থেকে কিছু খ্রিস্টান পালিয়ে শামে গিয়েছিল। তারা সেখানে গিয়ে মিসরে খ্রিস্টানদের উপর কি জুলুম-অত্যাচার চলছে তার বিবরণ দিয়েছে। আমাদের সর্দারদের এ সামর্থ নেই যে তারা বাহিনী তৈরী করে মিসর আক্রমণ করবে। তাই তারা এক মুসলমান সিপাহসালার আমর ইবনে আসের নিকট প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছিল। তাদের মাঝে দুজন পাদ্রীও ছিল।
তারা সিপাহসালারের সাথে সাক্ষাৎ করে মিসরের খ্রিস্টানদের দুর্দশা ও নির্যাতন নিপীড়নের অবস্থা তুলে ধরল। তারপর বলল, যদি মুসলমানরা মিসর আক্রমণ করে তবে তারা শাম থেকে ত্রিশ চল্লিশ হাজার যোদ্ধা দিতে পারবে।
দলপতি একের পর এক অনেক কথা বলতে লাগল। আর বিন ইয়ামীন মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগল। দলপতির মূল কথা ছিল, যদি মিসরের খ্রিস্টানরা সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাহলে মুসলমানরা মিসরে আক্রমণ করবে। আর যদি তারা বিদ্রোহ করতে সাহস না পায় তাহলে আক্রমণের সময় মুসলমানদের সাহায্য করলেও চলবে। আমর ইবনে আস (রা.) তাদের যে দায়িত্ব দিয়ে, যে উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছিলেন, ঠিক সে উদ্দেশ্যের কথাই ধীরে ধীরে দলপতি ব্যক্ত করল।
তারপর দলপতি বলল, আমি আপনাকে আরেকটি কথা বলল। এ বিষয়টি দেখে আমাদের খুব কষ্ট হয় যে, খ্রিস্টানরা আজ বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত হয়ে গেছে। বর্তমান অবস্থায় এটা আমাদের জন্য দারুণ ক্ষতিকর। আর এ প্রথাও খ্রিস্টানদের খুব ক্ষতি করছে যে তারা ধর্মীয় আমেজে অন্যায়ভাবে প্রত্যেক বৎসর একজন কুমারী যুবতাঁকে নীল নদে নিক্ষেপ করে হত্যা করে। মিসরের খ্রিস্টানরাই এ গর্হিত কাজটি করে। আপনি কি তা বন্ধ করতে পারেন না?