কিন্তু পাদ্রী তার সমস্ত আশা ভরসা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে বলল, অলঙ্কার আর সাজগোছ তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। একজন কুমারী মেয়েকে উৎসর্গ দেয়াই হল আসল কথা।
পাদ্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করা গেল না। সে রাতেই হোরসীসের মেয়েকে নদীবক্ষে উৎসর্গ করা হল।
ইতিমধ্যে রোজী নীল নদ থেকে উঠে অনেক দূর চলে গেছে। ওয়াইস ও তার সাথীরা ভাড়া করে উট নিয়েছে। তাতে চড়ে তারা কাউস নামক স্থানে গিয়ে পৌঁছল। কাউস শহর থেকে দূরে হলেও অত্যন্ত সমৃদ্ধ এলাকা। হিরাক্লিয়াস ও কীরাসের বিপক্ষের খ্রিস্টানদের একটি শক্তিশালী কেন্দ্র। এখানে বীন ইয়ামীনের প্রভাব খুব বেশী। সবাই বিন ইয়ামীনের ভক্ত। তারা এখানে পৌঁছে নিজেদের খ্রিস্টান বলে পরিচয় দিল। বিন ইয়ামীনের অনুসারী হিসাবে ব্যক্ত করল।
ইতিমধ্যে দিনমনি পশ্চিমাকাশে কাত হয়ে যাই যাই করছে। রাত কাটানোর জন্য তারা একটি সরাইখানায় গিয়ে উঠল। ছিমছাম ছোট অথচ ভাল লাগার মত একটি সরাইখানা। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে তারা কথাবার্তা বলছিল।
এক মুসলমান গুপ্তচর বলল, আচ্ছা রোজী বলতো, আমাদের ব্যাপারে তো তোমার এখন আর কোন সন্দেহ নেই।
রোজী বলল, না, কোন সন্দেহ নেই।
কোন প্রকার শোবা সন্দেহ না থাকারই কথা। গত রাত থেকে সে তাদের সাথে আছে। যদি তাদের কোন বদ নিয়ত থাকত তাহলে নিশ্চয় এর মধ্যেই তা প্রকাশ পেয়ে যেত। রোজী মনে মনে ওয়াইসকেই বেশী ভয় পাচ্ছিল। ইউকেলিসকে পাওয়ার পর সে তাকে অবজ্ঞাভরে উপেক্ষা করেছে। তার সাথে অনেক দুর্ব্যবহার করেছে। তার মনে অনেক কষ্ট দিয়েছে। এখন যদি সে ওসবের প্রতিশোধ নেয় তবে বলতে হবে তার সে অধিকার আছে। কিন্তু ওয়াইস তার সাথে কোন দুর্ব্যবহার করেনি। কোন কটু কথাও বলেনি। বরং তার সাথে এমন ভদ্র আচরণ করছে যা দ্বারা বুঝা যায় যেন রোজী কোন সুন্দরী রূপসী যুবতী নয়। বরং তাদের সঙ্গী কোন মুজাহিদ।
রোজী বলল, ওয়াইস! তুমি বলেছিলে, মুসলমানরা তোমাকে নতুন জিন্দেগী দিয়েছে। তুমি দেখেছিলে, মুসলমানরা শুধু তেমার প্রতি অনুগ্রহই করেনি, বরং শত্রুর সাথে এমন ব্যবহার করা তাদের ধর্মীয় বিধান। তাই তুমি মুগ্ধ হয়ে তাদের ধর্ম গ্রহণ করে নিয়েছ। এখন তুমি আর তোমার সাথীরা আমাকে নতুন জিন্দেগী দিলে। আমার বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিল, আমার স্বধর্মীয়রা আমার হাত বেঁধে আমাকে নীল নদে নিক্ষেপ করবে। তোমরা না এলে এখন আমার লাশ নদীর প্রাণীরা টেনে টেনে খেয়ে ফেলত।
ওয়াইস বলল, আল্লাহর হুকুম ছিল তুমি জীবিত থাকবে। তাই আল্লাহ্ তোমাকে মুক্ত করার জন্য আমাদের সেখানে পাঠিয়েছিলেন। যেখানে তোমার জীবন মরণের ফয়সালা হচ্ছিল। তোমাকে আমরা নয় বরং ইসলামী আদর্শ নতুন জিন্দেগী দান করেছে।
রোজীর দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে। সে বলল, ওয়াইস! তাহলে আমাকেও তোমাদের ধর্মে শামিল করে নাও। আমাকে মুসলমান করে নাও। আমার একটুও বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিবে। এখন আমি তোমার ও তোমার সাথীদের আচরণে এতো প্রভাবিত হয়েছি যে, আমি আমার জীবন তোমাদের আদর্শের জন্য ওয়াকফ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
ওয়াইসের দলপতি বলল, রোজী! এখন নয়। হয়তো পিতামাতার নিকট পৌঁছলে তোমার মনের খেয়াল পরিবর্তন হতে পারে। এখন তোমার মনে বিভিন্ন ভীতি শংকা ভর করে আছে। তাছাড়া তোমার বয়সও কম। কম বয়সীরা সাধারণত আবেগ প্রবণ হয়ে থাকে। আগে তুমি তোমার পিতামাতার নিকট যাও। তারপর তুমি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিও।
রোজী মনে মনে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে ইসলাম গ্রহণ করবে। তাই এদের কথা শুনে সে কেঁদে ফেলল। রোরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, আমি আমার পিতামাতার নিকট একা ফিরে যাব না। তোমাদেরকে সাথে নিয়ে যাব। ওয়াইস তাকে বলেছিল, ব্যবসার জন্য তারা মিসরে এসেছে। তাই রোজীর দাবী সে তাদের সাথেই ফিরে যাবে। অন্য কারো সাথে নয়।
কিন্তু তাকে তো আর একথা বলা যায় না যে, তারা ব্যবসার জন্য নয়, অন্য মিশন নিয়ে তারা এখন মিসরে আছে। তাই তাদের সাথে তার না থাকাই ভাল। কিন্তু রোজীর একগুঁয়েমী ও আহাজারী বেড়েই চলল। এক পর্যায়ে সে বলেই ফেলল, আমি আর খ্রিস্টান নই, আমি এখন মুসলমান।
রোজী অত্যন্ত সাহসী মেয়ে। কোন প্রকার ভয় ভীতি তার অন্তরে নেই। কঠিন মুহূর্তেও তাকে নিয়ে কোন সমস্যা হবে না ভেবে দলপতি তার সঙ্গীদের সাথে পরামর্শ করল। তাকে ইসলামে দীক্ষা দেয়া হলো। নাম রাখা হলো রাবেয়া। রোজী এখন রাবেয়া। একজন মুসলমান। এখন তার জীবন রক্ষা করা অপর মুসলমানের দায়িত্ব। তাকে এখন আর বিপদের মুখে ফেলে যাওয়া যাবে না। সবদিক বিবেচনা করে তারা রাবেয়াকেও তাদের মিশনের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে নিল।
তারা রাবেয়ার নিকট তাদের মিসরে আগমনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য খুলে বলল। বলল, তারা এখন মিসরীয় খ্রিস্টানদের অবিসংবাদিত নেতা ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় পাদ্রী বিন ইয়ামীনের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছে। তারা তার নিকট একথা কিছুতেই প্রকাশ করবে না যে, তারা মুসলমান। তারা বলবে, আমরা খ্রিস্টান। শামের খ্রিস্টান সর্দারের পত্র নিয়ে আমরা এসেছি।
রাবেয়ার কণ্ঠ অত্যন্ত উফুল্ল শোনা গেল। বলল, আমি সুখে-দুখে সর্বদা তোমাদের সাথে থাকব। প্রয়োজনে প্রাণ দিব। তবে এমন নয় তো যে, আমাকে নীল নদে ডুবিয়ে মারা হবে!