মিসরী পাদ্রী সামবীল সম্রাট হিরাক্লিয়াসের রাজকীয় খ্রিস্টধর্ম মেনে নিতে পারেনি। পাদ্রী কীরাস এ সংবাদ পেল। রেগে মেগে আগুন হয়ে কীরাস সামবীলের নামে এক ছোট্ট পত্র লিখে পাঠাল। তাকে রাজকীয় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে নেয়ার উদাত্ত আহ্বান জানাল। পত্রটি এক সালালের হাতে দিয়ে একশত সৈন্যসহ সালারকে সামবীলের নিকট পাঠাল। সাথে সাথে প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলীও দিল। সালার গিয়ে চিঠিটি পাদ্রী সামবীলের হাতে দিলে সে তা খুলে পাঠ করল। চিঠি পড়ে তার মাথায় খুন চড়ে গেল। ধর্ম নিয়ে এ কী খেলা শুরু হল! বিন ইয়ামীন ছাড়া আমাদের ইমাম আর কেউ নয়। এ কথা বলেই চিঠিটি ছিঁড়ে ফেলল। তারপর বলল, যে এ পত্র লিখেছে তার উপর আল্লাহর লানত। আর ঐ রোম সম্রাটের উপরও লানত যে আমাদের উপর এক মনগড়া ধর্ম চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে।
সামবীলের এ ধৃষ্টতা দেখে ও উত্তেজক কথাবার্তা শুনে সালার আর দেরি করল না। সাথে সাথে তাকে গ্রেফতার করল। তার হাত পিছমোড়া করে বাধল। সালার ঘোড়ায় চড়ে সামবীলকে তার সাথে বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে চলল। লোকেরা এ অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে রইল। হৃদয়ে তাদের বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারল না।
লোকদের দেখে সামবীল বেদনা বিধূর কণ্ঠে চিৎকার করে বলল, ভাইয়েরা আমার! আজ আমি আনন্দিত। ঈসা (আ.)-এর অনুসারী হওয়ার কারণে আজ আমার শরীর থেকে রক্ত ঝরবে। ভাইয়েরা আমার! তোমরা সঠিক ধর্ম আঁকড়ে ধরে থাকবে। কোন রাজা বাদশাহকে ভয় করবে না। তারপর সে কীরাসকে গালি দিতে লাগল।
সৈন্যরা তাকে মারতে মারতে কীরাসের নিকট যখন নিয়ে গেল তখন তার শরীরে জায়গায় জায়গায় জখম হয়ে রক্ত ঝরছে। রক্তে রক্তে তার দেহ লাল হয়ে গেছে।
কীরাস সামবীলকে লক্ষ্য করে বলল, ওহে পাপীষ্ঠ! তোকে কে পাদ্রী বানিয়েছে? আর তোকে কে এই অধিকার দিল যে, আমার অধীনস্থ হয়ে আমার বিরুদ্ধাচরণ করছিস। বল হে নরাধম! এমন করছিস কেন?
সামবীল বজ্র নির্ঘোষ কণ্ঠে বলল, ওহে দাজ্জাল! আল্লাহর ইবাদত আর বিন ইয়ামীনের আনুগত্যে রয়েছে নেকী। তুই তো ইবলিসের চেলা। তোর কথা মানা আর তোর ধর্মমতের অনুসরণ করা পাপ। মহাপাপ।
কীরাসের চোখ আগুনের গোলক হয়ে গেল। হুকুম দিল, তার মুখে ঘুষি মারতে মারতে ফুলিয়ে ফেল। ব্যস্ তাই হল। ঘুষি মারতে মারতে তার চেহারা ফুলিয়ে দিল।
তারপর কীরাস জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা বলতো, তুমি কেন মিসরের শাসক ও ধর্মীয় গুরুর কথা মানছো না? তুমি কি জান না, তোমার জীবন ও মরণ আমার হাতে?
সামবীল ক্রোধে গর্জন করে উঠল। বলল, হে কীরাস! তুমি কি ইবলিসের কথা জান না? ইবলিস ফেরেস্তাদের সর্দার ছিল। কিন্তু অহংকার তাকে আল্লাহর হুকুম মানতে অবাধ্য করল। সে আজ অভিশপ্ত। হে কীরাস! তুমি আজ ইবলিসের চেয়ে অধিক অভিশপ্ত।
কীরাস অহংকারে আগুনের মত জ্বলে উঠল। বলল, যাও এ নরাধমকে নিয়ে তার শির ধর থেকে ছিন্ন করো। তাহলে সব তেজ শেষ হয়ে যাবে।
***
জেলে আর মাঝি মাল্লাদের নিয়ে পল্লীর খ্রিস্টান সর্দার বাবাজ্বী সে রাতেই নীল নদের যে স্থানে রোজীকে উৎসর্গ করা হবে নৌকা দিয়ে সেদিকে যাচ্ছিল। নদী পথ অল্প। বাবাজ্বী যেদিকে যাচ্ছিল সে দিকে ছিল পানি প্রবাহ। তর তর্ করে তার নৌকা গন্তব্যের দিকে ছুটে যায়। কিছুদূর যেতেই দেখতে পায়, নদীবক্ষে একটা নৌকা উল্টে আছে। একটু দূরেই বৈঠা ভাসছে। কিন্তু কার নৌকা তা সে বুঝতে পারল না। এ কথা বুঝতে পারল না যে, এটা তাদের লোকদের নৌকা। বুঝতে পারল না, যাকে নদীবক্ষে উৎসর্গ করার জন্য নেয়া হচ্ছিল সে আরেকবার পালিয়ে গেছে।
নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেখল, তার আগে অন্যরা সেখানে উপস্থিত হয়ে কি যেন খুঁজছে। কয়েকজন সর্দার, তাদের সাথে একজন নেতৃস্থানীয় পাদ্রীও রয়েছে। বাবাজ্বী পৌঁছতেই পাদ্রী মহাশয় তার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার? যে কুমারীকে উৎসর্গ করা হবে সে কোথায়?
বাবাজ্বীর কণ্ঠে এক আকাশ বিস্ময় ঝরে পড়ল। বলল, আপনি এ কেমন কথা বলছেন। পাঁচজন লোকসহ তো তাকে অনেক আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি!
এ কথা শোনার পর সেখানে হায় হায় রব উঠল। বাবাজ্বী বলল, আমি আসার সময় দেখলাম নদী বক্ষে একটি নৌকা উল্টে আছে। কিন্তু মাঝি দুজনতো বেশ পারদর্শী। কোন কারণে যদি নৌকা উল্টে গিয়ে থাকে তাহলে মাঝি দুজন তো সাঁতরে চলে আসবে। আর কুমারী মেয়েটিও তো সাঁতার জানে।
তারপরই বাবাজ্বী বলল, নৌকায় তিনজন অপরিচিত লোক ছিল। তারা না হলে মেয়েটিকে উৎসর্গের জন্য তৈরী করাই মুশকিল ছিল।
পাদ্রী বলল, নীল নদী এ মেয়ের উৎসর্গকে কবুল করেনি। নীল নদের ক্রোধ থেকে বাঁচতে হলে ঐ মেয়েকেই উৎসর্গ করতে হবে যাকে আগে নির্বাচন করা হয়েছিল। হোরসীসের ঐ মেয়েকে নিয়ে আস। তাকে এনে নীলের বক্ষে নিক্ষেপ কর। তাহলেই নীল শান্ত থাকবে।
পাদ্রীর নির্দেশে সাথে সাথে কয়েকজন লোক হোরসীসের বাড়িতে ছুটে গেল। তাকে ঘুম থেকে জাগ্রত করে বলল, আপনার মেয়েকে নিয়ে এক্ষণই যেতে হবে। এটা পাদ্রীর নির্দেশ। হোরসীস এ সংবাদে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। পাদ্রীর নির্দেশ অমান্য করাও সম্ভব নয়। তাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মেয়েকে নিয়ে পাদ্রীর নিকট পৌঁছল। বিগলিত কণ্ঠে বলল, গুরুজ্বী পাদ্রী মহোদয়! আমার এ মেয়ের সমস্ত অলঙ্কার ঐ মেয়েকে পরিয়ে দিয়েছি যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। এখন তাকে পরানোর মত কোন অলঙ্কার নেই। তার আশা ছিল, হয়তো একথা বললে তার উৎসর্গ মুলতবী করে দিতে পারে।