নীল নদের তীরে আর বেশীক্ষণ থাকা ঠিক হবে না ভেবে তারা সেখান থেকে বিন ইয়ামীনের নিকট পৌঁছার পথ ধরে চলতে লাগল।
***
মুসলমান গুপ্তচর তিনজন অনেক চিন্তাভাবনা করে দেখেছে যে, মিসরে রোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সৃষ্টি করতে হলে বিন ইয়ামীনকে ছাড়া সম্ভব নয়। তার সেই শক্তি আছে। সেই জনপ্রিয়তা তার আছে। আর তার দ্বারাই তা করানো যেতে পারে। এর পিছনে আছে এক রক্তাক্ত ইতিহাস। এক মর্মন্তুদ বেদনাময় কাহিনী।
দীর্ঘদিন যাবৎ খ্রিস্টানরা বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে বিষ উদগিরণ করে আসছিল। তারা কেউ কাউকে সহ্য করতে পারত না। পরস্পরে প্রায়ই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
সম্রাট হিরাক্লিয়াস দেখল, ধর্মের নামে এ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধ করা দরকার। সে সকল দল উপদলকে ভেঙে চুড়ে খ্রিস্টানদের এক পতাকা তলে সমবেত করার ফর্মুলা খ্রিস্টান জাতির নিকট পেশ করল। তোষামুদে পাদ্রীরা সম্রাট হিরাক্লিয়াসের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে তা গ্রহণ করে নিল। কিন্তু মিসরের খ্রিস্টানরা তা মেনে নিল না। তারা তাদের পূর্ব ধর্মমত ছাড়া নতুন কিছু গ্রহণ করবে না। তারা সম্রাটের সমালোচনা শুরু করল ও রাজকীয় খ্রিস্টধর্ম বর্জন করল। সম্রাট হিরাক্লিয়াস এক শীর্ষস্থানীয় পাদ্রী কীরসকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দিয়ে সকল খ্রিস্টানকে রাজকীয় খ্রিস্টধর্ম মেনে নিতে বাধ্য করতে নির্দেশ দিল।
কীরস ইস্কান্দারিয়াতে এক সম্মেলনের আয়োজন করল। রাজকীয় খ্রিস্টধর্ম প্রচারের আয়োজন করল। তার এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। আল্লাহর কিতাব ইঞ্জিল বাদ দিয়ে সম্রাটের দেয়া খ্রিস্ট ধর্মকে মিসরের কেউ মেনে নিল না। পাদ্রী ও ধর্মজাযকরা এর প্রবল প্রতিবাদ জানাল। আমজনতা তা প্রত্যাখ্যান করল। সবার শীর্ষে রইল পাদ্রী বিন ইয়ামীন। সে কড়া ভাষায় তার প্রতিবাদ করল। সমালোচনা করল।
সম্রাটের কোপানলে পড়ে গেল বিন ইয়ামীন। সম্রাট তাকে বন্দী করে হত্যার নির্দেশ দিল। বিন ইয়ামীনের নিকট কোন সামরিক শক্তি ছিল না। সম্রাটের বিরুদ্ধে কোন কিছু করার ক্ষমতাও ছিল না। তারপরও সে খ্রিস্টধর্মকে রক্ষার জন্য সাময়িকভাবে আত্মগোপন করে থাকার কথা ভাবল। এ ছাড়া তার কোন উপায়ও ছিল না। সে কাউস নামক স্থানে দুর্গম এলাকায় তার আস্তানা। বানাল। সেখান থেকেই মিসরীয়দের বিভিন্ন ধর্মীয় নির্দেশ দিতে লাগল। মিসরের লোকেরাও সকল বিপদ মসীবতকে উপেক্ষা করে তার নির্দেশ মতে ধর্মাচার পালন করতে লাগল।
বিন ইয়ামীনের কোন সন্ধান না পেয়ে কী আরো ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল। বিন ইয়ামীনের বড় ভাইকে গ্রেফতার করে নিয়ে এল। কীরস জানে যে, বিন ইয়ামীনের মিসন তার অবর্তমানে তার ভাই পরিচালনা করছে। তাই কীরস তাকে রাজকীয় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার নির্দেশ দিল।
বিন ইয়ামীনের ভাই তা অস্বীকার করল। অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলল, আমি আল্লাহর দেয়া বিধান মানতে বাধ্য। মানুষের দেয়া কোন বিধান মানা সম্ভব নয়। আরো বললো, রোমের সম্রাট হিরাক্লিয়াস একজন পাপী বাদশাহ। আসল বাদশাহ আল্লাহ। তিনি এ দুনিয়ার এবং পরকাল উভয় জাহানের বাদশাহ। আমি শুধু তারই হুকুম মানব, অন্য কারো নয়।
এরপর আর দেরি হয়নি। লোমহর্ষক শাস্তি তার উপর নেমে আসে। তাকে বিবস্ত্র করে তার শরীর মশালের আগুনে পুড়িয়েছে আর বলেছে–বল, রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের ধর্মমত সত্য। আর বাকী সব ধর্মমত মিথ্যা।
বিন ইয়ামীনের ভাই আগুনে পুড়তে পুড়তে চিৎকার করে বলেছে, লানত ঐ ব্যক্তির উপর সে বিশ্বাস করে হিরাক্লিয়াসের ধর্মমত সত্য। বরং ইঞ্জিলের ধর্মমত চিরসত্য।
আগুনে জ্বলে জ্বলে তার শরীর দিয়ে চর্বি গলে গলে পড়েছে তবুও সে হিরাক্লিয়াসের ধর্মমতকে সত্য বলেনি। তারপর আগুন সরিয়ে নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছে, তুমি যদি বল, বিন ইয়ামীন কোথায় আছে, তাহলে তোমাকে ছেড়ে দেব।
সে তখন অত্যন্ত ঘৃণাভরে তার দিকে তাকিয়ে বলেছে, যদি আমি জেনেও থাকি তবুও তোমাকে তা কেন বলব?
তখন তার একটি দাঁত তুলে ফেলে পুনরায় জিজ্ঞেস করেছে। সে ঐ একই উত্তর দিয়েছে। তারপর তার আরেকটি দাঁত তুলে ফেলে জিজ্ঞেস করেছে। সে ঐ একই উত্তর দিয়েছে। এভাবে নির্মমভাবে কষ্ট দিয়ে নির্যাতন করে তার সবগুলো দাঁত তুলে ফেলেছে। তার মুখ দিয়ে তখন অবিরাম রক্ত ঝরে পড়ছিল।
এরপর তাকে তিনবার জিজ্ঞেস করা হয়েছির, বল সম্রাট হিরাক্লিয়াসের ধর্মমত সত্য। কিন্তু প্রত্যেক বার সে উত্তরে বলেছে, সম্রাটের ধর্মমত মিথ্যা, অবাস্তব। ইঞ্জিলের ধর্মমত সত্য। তারপর পাদ্রী কীরাসের নির্দেশে হাত পা বেঁধে তাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়। এভাবে পানিতে ডুবিয়ে তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করা হয়।
ধর্মের লেবাসে কীরাস অনেক মানুষের উপর নির্যাতন করেছে। অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। অনেককে চিরদিনের জন্য পঙ্গু করে দিয়েছে। ধার্মিক মানুষেরা তার হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে ধুকে ধূকে নিঃশেষ হয়ে গেছে। ইতিহাসের পাতায় এ ধরনের নির্যাতনের বহু ঘটনা আজো পাঠকের চোখ থেকে অশ্রু ঝরাচ্ছে।
পাদ্রী সামবীলকে নিয়ে যা ঘটেছিল আজো তা কেউ ভুলেনি। সামবীল ছিল বিন ইয়ামীনের অনুসারী। বিন ইয়ামীনের কথাবার্তা, আচার আচরণ তার ভাল লাগত। তাই সব বিষয়ে তার অনুসরণ করত। তার পরামর্শ নিয়ে চলত।