প্রশিক্ষণ শেষ হলে তারা মিসরে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তারা ব্যবসায়ীর রূপ ধারণ করে মিসরে যাচ্ছে। মাত্র এক মাস মিসরে থেকে তারা দুতিনজন নেতৃস্থানীয় মিসরীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ভাব সৃষ্টি করেছে। মিসরী খ্রিস্টানরা তাদেরকে তাদের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছে।
***
গুপ্তচর বৃত্তির কাজে এদিক দিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। হঠাৎ ওয়াইসের দৃষ্টি রোজীর উপর নিপতিত হল। রোজীর জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে ওয়াইস কিছুতেই সে দিকে ফিরেও তাকাতো না। রোজীকে দেখেই সে তার সঙ্গী সাথীদেরকে দূরে নিয়ে তার সাথে রোজীর সম্পর্কে কথা বলল। কিভাবে সুদূর এ মিসরে এসে এ বিপদে সে আটকে গেছে সে কথা ভেবে তারা কোন কূল কিনারা পেলো না।
ওয়াইস সমবেত লোকদের একজনকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ভাই! এ মেয়েটির কি হয়েছে? লোকটি বলল, এ মেয়েটিকে নীল নদীতে উৎসর্গ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু সে তাতে রাজী নয়। ওয়াইস ও তার সাথীরা এসব কিছু জেনে পরামর্শ করল। কিভাবে রোজীকে উদ্ধার করা যায়। তার পন্থাও বের করল। তারপর ওয়াইস ও তার সাথীরা মিসরী খ্রিস্টানের রূপধরে সমবেত লোকদের ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেল এবং যারা রোজীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোর প্রয়োগ করছিল তাদের নিকট থেকে রোজীকে নিজেদের হাতে তুলে নিল।
তারা কৌশলে কামিয়াব হল। তারা মিসরী দুজনকে হত্যা করে নদীবক্ষে নিক্ষেপ করল। সেখানে নদী খুব প্রশস্ত। নদীর মাঝ দিয়ে নৌকাটি তর তর করে এগিয়ে চলছে। এখন তাদের সবচেয়ে জরুরী কাজ হল তীরে নৌকা ভিড়িয়ে দ্রুত অন্যত্র চলে যাওয়া। কিন্তু আরবরা তখনো নৌকা চালনায় পারদর্শী হয়ে উঠেনি। দজলা ও ফুরাত নদীতে আরবরা ছোট ছোট নৌকা চালাতে পারত। নৌকা নিয়ে এদিক সেদিক যাতায়াতও করত। কিন্তু পালের নৌকা চালাতে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেনি।
ওয়াইস ও তার সাথীরা জানে যে, নৌকার গতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পিছনে বৈঠা ব্যবহার করতে হয়। বৈঠা ঘুরালেই নৌকার মুখ ঘুরে যাবে। তাদের একজন নৌকার বৈঠা ঘুরিয়ে দিল। নৌকার মুখ তীরের দিকে ফিরে গেলেও পালের নৌকা ভারসাম্য হারিয়ে এক দিকে হেলে গেল। পালের নৌকা কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় তা তাদের জানা ছিল না। প্রচণ্ড বাতাসের ঝাঁপটা ও ঢেউয়ের কারণে নৌকায় পানি উঠতে লাগল।
এক মুজাহিদ ভীত সন্ত্রস্ত কণ্ঠে বলল, মেয়েটির দিকে খেয়াল রাখ।
রোজী দৃঢ়তার সাথে বলল, আমার চিন্তা করতে হবে না। আমি সাঁতার কাটতে পারি। সাঁতরেই আমি তীরে উঠেছি এবং এখনো বেঁচে আছি।
তারা আর বেশী কথা বলতে পারল না। বাতাসের একটি প্রবল ঝাঁপটা এসে পালে লাগতেই নৌকাটি এক দিকে কাত হয়ে উল্টে গেল। সবাই সাঁতার জানে। তারা তীরের দিকে সাঁতার কাটতে লাগল। ওয়াইস উল্কণ্ঠিত হয়ে রোজীকে ডাকতে লাগল। তারা সকলে সাঁতার কেটে তীরে গিয়ে পৌঁছল।
***
এখন একটি চিন্তা তাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। রোজীকে তারা কেথায় লুকিয়ে রাখবে। কিভাবে তারা তাকে শামে পৌঁছে দেবে। এটা তাদের দায়িত্ব নয়। কিন্তু ওয়াইস স্বেচ্ছায় যেন এ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। তারা মিসরী খ্রিস্টানদের সর্বশ্রেষ্ঠ গুরু ও পাদ্রী বিনইয়ামীনের নিকট যাচ্ছিল।
বিন ইয়ামীন কোন জনবসতিতে বসবাস করে না। কাউস নামক স্থান অতিক্রম করে এক বিস্তৃত বালুকাময় অঞ্চল। তারপর চড়াই উত্রাই ও দুর্গম পথ পেরিয়ে বিন ইয়ামীনের নিকট পৌঁছতে হয়। হিরাক্লিয়াসের রাজকীয় খ্রিস্টধর্মকে যারা মানে না তারা বিন ইয়ামীনকেই তাদের আধ্যাত্মিক নেতা মনে করে। তার আদেশ নিষেধ অম্লান বদনে মেনে নেয়। সম্রাট হিরাক্লিয়াস বিন ইয়ামীনকে হত্যার জন্য পাদ্রী কীরসকে অনুমতি প্রদান করেছিল। গোপন সূত্রে বিন ইয়ামীন সংবাদ জানতে পেরে শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে এবং দুর্গম মরু অঞ্চলে আত্মগোপন করেছে। সে বিশ্বস্ত অনুসারীদের মাধ্যমে এখনো তার ধর্মীয় নেতৃত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
আমর ইবনে আস (রা.) এর প্রেরিত গুপ্তচরদের সফলতা যে, তারা বিন ইয়ামীনের ঠিকানা সংগ্রহ করতে পেরেছে। তারা নিজেদেরকে মিসরী প্রকাশ করত এবং মিসরীয়দের গির্জায় গিয়ে খ্রিস্টানদের মত ইবাদত করত। এভাবে মিসরীয়দের প্রবঞ্চনায় ফেলে তাদের থেকে বিন ইয়ামীনের ঠিকানা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে।
কিন্তু রোজীকে নিয়ে তারা দারুণ সমস্যায় পড়ল। ওয়াইসের ব্যাপারে তো এ কথা চিন্তাও করা যায় না যে, সে তার দায়িত্ব ফেলে রোজীকে তার মাতাপিতার নিকট পৌঁছাতে শামে চলে আসবে। আবার রোজীকে সাথেও রাখা বিপদ। আবার তাকে একা ফেলেও যাওয়া সম্ভব নয়। তিনজনে এ বিষয়টি নিয়ে ভাবল। পরামর্শ করল।
তাদের তিনজনের যে আমীর সে বলল, আচ্ছা এমন করলে কি হয় না যে, আমরা রোজীকে আমাদের সাথেই নিয়ে যাই। এবং বিন ইয়ামীনের নিকট রোজীকে সমর্পণ করে বলি, আপনি তাকে আলেপ্পায় প্রেরণের ব্যবস্থা করে দিন।
একজন বলল, যদি সে জানতে পারে যে, তাকে নীল নদীতে বিসর্জন দেয়ার জন্য নেয়া হচ্ছিল, আমরা তাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি। তাহলে কি হবে?
আমীর বলল, এ ধরনের চিন্তা মনে জায়গা না দেয়াই ভালো। কারণ আমি শুনেছি, বিন ইয়ামীনও নীল নদে যুবতী বিসর্জনের পক্ষপাতী নয়। সে একে পাপ মনে করে। তবে সে এখন মিসরীয় খ্রিস্টানদের সমর্থন ধরে রাখার জন্য এ বিষয়টি নিয়ে কোন কথা বলছে না।