এবার আন্তোনীস ও লীজার নিকট রাতাসের কথা বিশ্বাসযোগ্য বলে বিবেচিত হল। আন্তোনীস তাকে বলে দিল, তোমার কথা বিশ্বাস করলাম। কিন্তু যদি কোথাও তুমি আমাদের ধোকা দেয়ার সামান্যতম চেষ্টা কর তাহলে তোমাকে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হবে।
এবার রূতাস জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
উত্তরে আন্তোনীস অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় তার গন্তব্য স্থানের কথা বলে দিল।
রূতাস বলল, তাহলে আপনি আমাকে একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী পাবেন। আমি তো দিশেহারা পথিকের ন্যায় ঘুরে ফিরছিলাম। আপনি আমাকে আমার মনযিলের সন্ধান দিলেন। আরব খ্রিস্টান কবিলাগুলোর সর্দারদের আমিও বেশ ভালভাবেই চিনি। তাদের সাথে আমার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর।
রাতের অধিকাংশ সময় কেটে গেছে। বিশ্রামের জন্য তারা কিছুক্ষণ শুয়ে রইল। সকালের নির্মল আলো ছড়িয়ে পড়তেই আবার তারা যাত্রা শুরু করল।
***
ইরাক ও শামের মধ্যবর্তী বিরাট বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আরব খ্রিস্টান কবিলাগুলোর বসবাস। এ কবিলার লোক ইসলাম বিদ্বেষী ও বিরোধী। আমীরুল মুমেনীন হযরত উমর (রা.)-এর নির্দেশে এদের দমন করা হচ্ছে। শায়েস্তা করা হচ্ছে।
খ্রিস্টান কবিলাগুলোর একটি বনু তাগলিবকে নিয়ে এক বিস্ময়কর মজাদার ঘটনা ঘটল। এ কবিতাটি শাম ও ইরাকের সীমান্ত ও ফুরাত অববাহিকার মাঝামাঝি অবস্থিত। শামেরও কিছু এলাকা জুড়ে এদের অবস্থান। মরু অঞ্চল। এ কবিলাকে দমন করার দায়িত্ব ওয়ালীদ ইবনে ওক্কবা (রা.)-কে দেয়া হয়েছে। বনু তাগলিব কয়েকটি বস্তিতে বসবাস করে। দুটি বস্তির রয়েছে সুদৃঢ় কেল্লা, তাবুত তাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
সালার ওয়ালীদ ইবনে উবা তাদের শায়েস্তা করতে অগ্রসর হলে বেশ কিছু বাধার সম্মুখীন হলেন। প্রধান বাধা হল, বনু তাগলিব প্রকৃতপক্ষেই যুদ্ধবাজ আর দুঃসাহসী। মুজাহিদদের যে বাহিনী প্রথমে মুসাল্লা ইবনে হায়েসা ও তারপর সাআদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা.)-এর নেতৃত্বে পারস্য সম্রাট কিসরার বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল, সে বাহিনীতে বনু তাগলিবের যোদ্ধারাও অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের কারো কারো বীরত্ব ও সাহসিকতা দেখে সত্যই আরব যোদ্ধারা বিস্মিত ও বিমোহিত হত।
কিন্তু রোমান শক্তির বিরুদ্ধে যখন মুজাহিদরা যুদ্ধ করছিল তখণ বনু তাগলিবের যোদ্ধারা বিদ্রোহ করে বসল। অথচ তখন গোটা ইরাক ও শাম মুসলমানদের পদানত হয়ে গেছে।
সালার ওয়ালীদ ইবনে উবার নেতৃত্বে মুজাহিদ বাহিনী বনু তাগলিবের দিকে অগ্রসর হল। বনু তাগলিবের যোদ্ধারাও অস্ত্রসজ্জিত হয়ে রণক্ষেত্রে নেমে এল। প্রাণপণে যুদ্ধ করেও বেশ কয়েকটি রণাঙ্গণে তারা পেরে উঠতে পারল না। রণাঙ্গণ ছেড়ে পিছু হটে গেল। মুজাহিদদের বিজয়ের পশ্চাতে কিছু কারণও আছে। তার একটি হল, মুজাহিদদের হাতে পারস্য ও রোম সম্রাটের বহু তাজা ঘোড়া রয়েছে। তাই অধিকাংশ মুজাহিদই অশ্বারোহী। মুজাহিদদের বিজয়ের আরেকদিক হল, তারা ইতিমধ্যে অপরাজেয় শক্তি বলে বিবেচিত রোমান বাহিনীকে পরাজিত করে শামের মরু অঞ্চলে ওদের ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। তাই মুজাহিদদের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল সর্বত্র। পৃথিবীর সকল শক্তি মুজাহিদদের নামে ভীত, সন্ত্রস্ত।
আরব কবিলাগুলোর খ্রিস্টান যোদ্ধারা মুজাহিদদের বিরুদ্ধে রণাঙ্গণে এলেও টিকে থাকতে পারল না। বনু তাগলিবের সাথেও কয়েকটি রাণাঙ্গণে বুঝাঁপড়া হয়েছে। কিন্তু বিজয় মাল্য ছিনিয়ে আনা অত্যন্ত দুঃসাধ্য ব্যাপার। তারা প্রত্যেকটি রণক্ষেত্রে পিছিয়ে গেছে। অবশেষে তাদের সর্দার সন্ধি করে মুসলমানদের আনুগত্য মেনে নিয়েছে। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করলো না।
সেদিনই সালার ওয়ালীদ ইবনে উক্কবা (রা) হযরত উমর (রা.)-এর নিকট পয়গাম দিয়ে পাঠালেন যে, আমি তাদের ইসলাম গ্রহণের প্রস্তাব দিলাম কিন্তু তারা তা অস্বীকার করেছে। তারা এখন আমীরুল মুমিনীনের ফয়সালার অপেক্ষায় আছে।
হযরত উমর (রা.)-এর দূরদর্শিতা ও গভীর প্রজ্ঞার কথা সর্বজন জ্ঞাত। উত্তরে তিনি লিখলেন, বনু তাগলিবকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে চাপ দিবে না। ইসলাম গ্রহণ করা বা না করা তাদের ইচ্ছা। তবে তাদের সর্দারদের বলে দিবে, যদি তাদের গোত্রের কেউ স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করে তবে তারা তাকে বাধা দিতে পারবে না।
হযরত উমর (রা.)-এর উত্তর পত্র পেয়ে সালার ওয়ালীদ ইবনে উক্কবা যখন তা বনু তাগলিবের সর্দারদের শুনালেন, তখন তা তাদের মনে দারুণ ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল, তখনই বেশ কিছু খ্রিস্টান মুসলমান হয়ে গেল।
উমর (রা.) তার পয়গামে আরো লিখলেন, বনু তাগলিব থেকে জিযিয়া কর গ্রহণ করা হবে। তারা জিম্মি হিসাবে বসবাস করবে। এ বিষয়টি বনু তাগলিবের সর্দাররা মেনে নিতে পারল না। তারা বলল, আমরা জিযিয়া দিতে পারব না। আর আমাদের যেন জিম্মীও ডাকা না হয়।
বনু তাগলিবের এ কথা শুনে সালার ওয়ালীদ ইবনে উক্কবা দারুণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। বললেন, হে বনু তাগলিব! তোমাদের কারণে আমরা আমাদের বিধান রহিত বা পরিবর্তন করতে পারব না। তোমাদের প্রত্যেকটি একগুয়েমীর সমাধানের জন্য আমি আর মদীনায় কাউকে পাঠাব না। মনে রাখবে, জিযিয়া কিছুতেই মাফ করা হবে না।