যুদ্ধের পর মুজাহিদরা যখন জখমী মুজাহিদদের তুলে নিয়ে যাচ্ছিল, ওয়াইস তখন এক মুজাহিদের হাতে ধরে বাঁচার নিবেদন করল। মুজাহিদ তাকে পানি পান করাল। তারপর তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুকুম দিয়ে চলে গেল। দুজন মুসলমান মহিলা এসে দেখল, এক খ্রিস্টান যোদ্ধা আহত। মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। তারা খ্রিস্টান বা দুশমন মনে না করে একজন আহতমানুষ বিবেচনা করে তাকে তুলে নিয়ে গেল। জখমী মুজাহিদদের পাশে রেখেই তার সেবা শুশ্রূষা করা হল।
দুতিন দিন পরই ওয়াইস দুপায়ে দাঁড়ানোর শক্তি ফিরে পেল। আরো কয়েকদিন পর সে হাঁটা চলা করতে শুরু করল। মুসলমানদের আচার-ব্যবহার ও কথাবার্তায় সে বিমুগ্ধ হল। সে প্রায়ই ভাবত, তাকে তার সাথীরা মৃত্যুর গহ্বরে ফেলে চলে গেছে। অথচ দুশমনদের দুজন নারী সেবা যত্ন করে তাকে সুস্থ করে তুলেছে। এরা কত মহান। জখমী যে-ই হোক তাকে তারা সেবা করবে। চিকিৎসা করবে। জখমী মানুষ, আদম সন্তান। বন্ধু না শত্রু এ পার্থক্য তারা করে না। কতো উদার তাদের ধর্মচিন্তা। চিন্তার পরতে পরতে তার গোমরাহীর স্থান হেদায়েত দখল করে নিচ্ছে। মন তার ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গেছে।
একেবারে সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর তার সাথে যুদ্ধ বন্ধীর ন্যায় আচরণ করা দরকার ছিল। কিন্তু সালারের নির্দেশে তাকে মুক্তি দেয়া হল। সালারের এই অচিন্তনীয় আচরণে সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। সাথে সাথে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। সালারের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে সে মুসলমান হয়ে গেল। তার নাম রাখা হল ওয়াইস।
এই ওয়াইস ছিল আলেপ্পার অধিবাসী। একই কবিলায় ওয়াইস আর রোজী বেড়ে উঠেছিল। ওয়াইসকে দেখলে রোজীর বেশ ভাল লাগত। রোজীকে দেখলে ওয়াইসের অন্তরে ঝড় উঠত। একে অপরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করত। কথাবার্তা হত। নির্মল হাসি বিনিময় হত। ধীরে ধীরে তা প্রণয়ের দিকে গড়ায়। হৃদয় দেয়া নেয়ার পালা শুরু হল। ঠিক তখন রোজীর জীবনাকাশে ধূমকেতুর ন্যায় ইউকেলিস এসে উপস্থিত হল। রোজী আর ওয়াইসের প্রণয় বন্ধন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়।
মুসলমান হওয়ার পর ওয়াইস মুজাহিদদের সাথে যোগ দিল। তার প্রতিভা দেখে সবাই বিমুগ্ধ হল। সবার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। শুধু দুর্বার দুঃসাহসীই নয়। অসি চালনা, বর্শা নিক্ষেপ, তীর নিক্ষেপ, অশ্বারোহণসহ যুদ্ধের যাবতীয় কলাকৌশলে সে অত্যন্ত পারদর্শী। এরপর সবাই অনুধাবন করল, তার বুদ্ধিমত্তা, দূরদর্শীতা, স্বচ্ছ সঠিক চিন্তা এত তীক্ষ্ণ ও বিস্ময়কর যে গুপ্তচর বিভাগে তার মত মানুষ খুবই জরুরী।
***
সিপাহ সালার আমর ইবনে আস (রা.) আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-কে নানাভাবে মিসর আক্রমণে অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছেন। নানা যুক্তিও উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে, তাৎক্ষণিকভাবে আক্রমণের অনুমতি তিনি দেননি। বরং বলেছেন, শাম মাত্র বিজিত হয়েছে এখানে শাসন ব্যবস্থা সুদৃঢ় ও মজবুত করার পর অন্য চিন্তা করা যাবে। এখন আরেকটি নতুন রণাঙ্গন তৈরীতে তার মন সায় দেয়নি। তবে মিসর আক্রমণ করা দরকার ও করতে হবে তা তিনি অস্বীকার করেননি। সময় সুযোগে তা করা হবে এ আশ্বাস তিনি আমর ইবনে আস (রা.)-কে দিয়েছিলেন।
এদিকে মিসর আক্রমণের আগ্রহ আমর ইবনে আস (রা.)-কে চরমভাবে পেয়ে বসেছে। বার বার কেবল মিসর আক্রমণের চিন্তাই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তিনি প্রায়ই চিন্তা করেন, রোমান সৈন্যরা যারা শাম থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেছে তারা মিসরে গিয়ে আবার একত্রিত হবে। হিরাক্লিয়াস তাদের পুনরায় সজ্জিত করে এক দুর্ধর্ষ বাহিনীতে রূপায়িত করবে। তারপর আবার শাম আক্রমণ করবে।
তাই একটি কাজ করতে হবে, আরব খ্রিস্টান কবিলারা যেমন বিজয়ী মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল ঠিক তেমনিভাবে মিসরের নির্যাতিত খ্রিস্টানদেরও হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে হবে। যেন তারা রোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। একদিন তিনি তার অধিনস্ত সালারদের নিয়ে এ ব্যাপারে আলোচনায় বসলেন। কিভাবে মিসরীয়দের সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে উসকে দেয়া যায় তার পথ ও পন্থা কি হতে পারে।
আমর ইবনে আস (রা.) বললেন, মিসরের খ্রিস্টানরা সেখানে অত্যন্ত নির্যাতিত অবস্থায় আছে। তাদের বিদ্রোহী করে তুলতে হবে।
এক সালার বলল, তাদেরকে আমাদের অনুগত বানাতে হবে। আমাদের সাহায্যের ব্যাপারে তাদের উৎসাহী করে তুলতে হবে। যেন তারা এ ব্যাপারে এক মত পোষণ করে যে, আমরা মিসরে আক্রমণ করলে তারা আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। যে সব মিসরী রোমানদের সৈন্য বাহিনীতে আছে তারা যেন যুদ্ধের সময় উদাস থাকে, কৌশলে আমাদের মোকাবেলা এড়িয়ে চলে।
খুঁটি নাটি আরো অনেক বিষয় সম্পর্কে আলোচনা হল। সবশেষে আমর ইবনে আস (রা.) বললেন, আমার তিন চারজন মুজাহিদের প্রয়োজন যারা মিসরে গিয়ে মিসরীয়দের সাথে মিশে তাদেরকে হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে উসকে দেবে। তাদের বিদ্রোহী করে তুলবে।
গুপ্তচর হিসেবে কাজ করাতে অনেক মুজাহিদ প্রস্তুত। কিন্তু মিসরের ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যাকে তাকে দিয়ে এ কাজ হবে না। তাই সালার সর্বসম্মতিক্রমে দুজন মুজাহিদকে এ কাজের জন্য নির্বাচিত করলেন। তারপর তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে সবাই ওয়াইসকে নির্বাচন করল। আমর ইবনে আস (রা.) এ তিনজনকে নিজের নিকট রেখে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিলেন।