বাবাজ্বী এবার হাতের লাঠি উঁচিয়ে এগিয়ে এল। সবাই নিরব হয়ে গেল। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। বাবাজ্বী নির্দেশের সুরে বলল, একে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাও, নৌকায় তুলে মাঝ দরিয়ায় নিক্ষেপ করে এসো। দেরি করো না।
রোজী অসহায়। সে বসে পড়ল। লোক দুটি তাকে দাঁড় করাতে চেষ্টা করল। কিন্তু রোজী প্রাণপণে তাদের থেকে বাঁচতে চাচ্ছে।
***
৪. হঠাৎ জনতার ভিড়
হঠাৎ জনতার ভিড় ঠেলে তিন ব্যক্তি এগিয়ে এল এবং ঐ দুব্যক্তিকে পিছনে সরিয়ে দিল। রোজী চিৎকার করছিল। তাদের একজন রোজীকে উঠতে বলল। সে লোকটিকে দেখেই রোজী নিরব হয়ে গেল। তার চেহারার রং একেবারে পাল্টে গেল। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। সে লোকটি এবার যে লোক দুটি রোজীকে তুলতে চাচ্ছিল তাদের দূরে সরিয়ে দিল। তারপর রোজীর নিকট এগিয়ে এল।
রোজীর কণ্ঠে এক আকাশ বিস্ময়! মৃদু কণ্ঠে বলল, তুমি! তুমি কি রবিন!
লোকটি কানে কানে কথা বলার সুরে বলল, হ্যাঁ, আমি রবিন। তবে আমাকে সবাই ওয়াইস নামে চিনে।
রোজী বলল, প্রতিশোধ নেয়ার উত্তম সময় তুমি পেয়ে গেছো।
তিনজনের একজন বলল, এখন বাজে কথা রাখ। যদি বেঁচে থাকতে চাও নিরবে নির্বিঘ্নে আমাদের অনুসরণ কর।
ওয়াইস বলল, আমার হৃদয়ে কোন দুমশনী নেই। এখনো আমি আমার হৃদয়ের মণি কোঠায় তোমার ভালবাসা সযত্নে লালন করে আছি।
তৃতীয় জন বলল, ওয়াইস! এখন এতো কথা বলার সময় নেই, আগে ওকে এদের কব্জা থেকে যুক্ত কর।
প্রায় কানে কানেই তারা এ কথাগুলো বলল। কেউ তা বুঝল না। আঁচও করতে পারল না।
অনুসন্ধিৎসু সমবেত লোকদের দিকে ফিরে ওয়াইস বলল, ভাইয়েরা আমার! এই যে এই মেয়েটিকে আপনারা দেখছেন, সে কিন্তু স্বেচ্ছায় সানন্দে নীল নদের শীতল বক্ষে নিজেকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। তবে আপনাদের সাথে নয়, সে আমাদের সাথে যেতে চায়।
বাবাজ্বী লাঠি হাতে এগিয়ে এল, বলল, দাঁড়াও। আমি তোমাদের চিনি না। তবে আমি বিমুগ্ধ যে, তোমরা এ পুণ্যের কাজটি নিজেদের জিম্মায় তুলে নিয়েছে। তবে আমি হৃদয়ের প্রশান্তির জন্য তোমাদের সাথে আমার দুব্যক্তিকে পাঠাতে চাই।
ওয়াইস ও তার সাথীরা দৃষ্টি বিনিময়ে কি যেন বলল। ওয়াইস একটু কেসে বলল, বাবাজ্বী! দুজন কেন, ছজন পাঠান। আমরা মিসরী খ্রিস্টান। আমাদের পক্ষে একে অপরকে ধোকা দেয়া কি সম্ভব!
যে দুই ব্যক্তি রোজীকে নেয়ার জন্য টানাটানি করছিল বাবাজ্বীর নির্দেশে তারা ওয়াইস ও তার সাথীদের সাথে রওয়ানা হয়ে গেল। রোজী যেন ওয়াইসের দর্শনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছে। এতক্ষণ তাকে নিয়ে যে অস্বস্থিকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল এখন তা আর নেই। শান্ত সুবোধ বালিকার ন্যায় সে এখন ওয়াইসের সাথে যাচ্ছে। সমবেত লোকেরা ছুটে গিয়ে তার গায়ে ফুল ছুঁড়ে দিয়ে তার সুনজর অর্জনের চেষ্টা করছে।
নীল নদের তীরে একটি মাঝারি গড়রেন নৌকা ভিড়ানো ছিল। নৌকায় দুজন মাঝিও ছিল। পাল তোলা নৌকা। তীরে পৌঁছে কবিলার মাঝি দুজনকে বাবাজ্বীর প্রেরিত লোকেরা বলল, আপনাদের যেতে হবে না। আমরাই নৌকা চালাতে পারি। মাঝিরা নেমে গেল।
রোজী, ওয়াইস ও তার দুই সাথী নৌকায় আরোহণ করল। পাল তুলে দেয়া হল। স্রোতের বিপরীত দিকে তাদের নৌকা চলছে। বায়ু প্রবাহের প্রচণ্ডতা কম। ধীরে ধীরে নৌকা চলছে। তখন রাতের অন্ধকার চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। দূরে দূরে আলোর মৃদু ঝলকানী দেখা যাচ্ছে। ছল ছল্ চলাৎ, ছল্ চল্ চলাৎ আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
বেশ কিছুক্ষণ চলার পর নৌকাটি যখন নীল নদের মাঝ দিয়ে চলছিল, তখন বাবাজ্বীর প্রেরীত লোক দুজন নৌকার মাঝে এসে বসল। ওয়াইস, তার দুই সাথী ও রোজী পিছনে বসে আছে। ওয়াইস তার সাথী দুজনকে ইঙ্গিত করল। তিনজনই কাপড়ের নিচ থেকে ধারালো খঞ্জর বের করল। অন্ধকারেও খঞ্জর তিনটি যেন ঝলমল করে উঠল। তাদের দুহাত সামনেই বসে আছে তাদের শিকার। সুতরাং দেরি হল না। লোক দুটি কিছু বুঝে উঠার আগেই তাদের বক্ষদেশ ভেদ করে দুটি খঞ্জর চলে গেল। আর্তচিৎকার করে একটু বাঁকা হতেই তাদের ধাক্কা দিয়ে নদীবক্ষে ফেলে দিল।
ওয়াইসের কণ্ঠ আবেগে আপ্লুত। বলল, রোজী! এবার বলতো আমাকে বিশ্বাস করতে পারছো কিনা? না এখনো আমার ব্যাপারে তোমার সন্দেহ আছে?
রোজীর কণ্ঠ কিছুটা শান্ত, বলল হা ওয়াইস। আমার মনে এখন আর কোন সন্দেহ নেই। তবে তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে?
ওয়াইস বলল, শামে…… আলেপ্পায়। তোমার পিতামাতার নিকট। রোজী। আমরা মুসলমান। আমরা মানুষের কল্যাণ কামনা করি। কখনো মানুষের অকল্যাণ কিছু করি না।
রোজী জিজ্ঞেস করল, এখানে তোমরা কিসের জন্য এসেছিলে!
ওয়াইস বলল, ব্যবসা করতে। ইস্কান্দারিয়াতে আমাদের পণ্যদ্রব্য পড়ে আছে। একজন ব্যবসায়ীর সাথে সাক্ষাৎ করতে আমরা এখানে এসেছিলাম।
ওয়াইস সত্য বলল না। ব্যবসার সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। তারা মুসলিম বাহিনীর মুজাহিদ। মুজাহিদ বাহিনীর গুপ্তচর বিভাগে তারা কাজ করে। ওয়াইস ছিল খ্রিস্টান। প্রচণ্ড শক্তি ছিল তার দেহে। সুশ্রী সুন্দর ছিল তার অবয়ব। দুই আড়াই বৎসর পূর্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে সে অংশগ্রহণ করেছিল। ভীষণ যুদ্ধ হচ্ছিল। যুদ্ধে এক পর্যায়ে সে জখমী হয়ে রণাঙ্গনে পড়ে রইল। প্রচুর রক্ষক্ষণের কারণে সে মৃত্যুর দুয়ারে গিয়ে পৌঁছল। তার সঙ্গী খ্রিস্টান সাথীরা তাকে রেখে পালিয়ে গেল।