ভাগ্যক্রমে আমি গতকালের উৎসর্গ অনুষ্ঠানে ছিলাম। আর মেয়েটিকে দেখেছিলাম। আজ ভোরে আমি শুনতে পেলাম, এক মেয়ে নীল নদের তীরে ঘুমিয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হয় সে নীল নদ থেকে উঠে এসেছে।
উপস্থিত এক ব্যক্তি বলল, এখন আমাদের কি কর্তব্য।
বাবাজ্বী বললেন, আমি কিছু বলতে পারব না। বড় পাদ্রী তা বলতে পারবেন। আমি এখন তার নিকটই যাচ্ছি। তোমাদের কেউ আমার সাথে চল। বড় পাদ্রীই সিদ্ধান্ত দিবেন, এখন আমাদের কী করতে হবে। আমরা কি পুনরায় মেয়েটিকে নীল নদে বিসর্জন দিব, না অন্য কোন মেয়েকে বিসর্জন দিতে হবে।
তবে আমার নিকট একটি বিষয় অস্পষ্ট, বিসর্জন দেয়ার সময় তার গায়ে অনেক অলঙ্কার ছিল। কিন্তু এখন তা দেখতে পাচ্ছি না কেন! হাতের আংটিটিও দেখছি না। আমি তাকে এসব কথা এ চিন্তা করে জিজ্ঞেস করিনি, যেন সে বুঝতে না পারে, আমি তাকে উৎসর্গ করার পূর্বে দেখেছি। তাহলে হয়তো সে বুঝে ফেলবে যে, তাকে আবার নীল নদে উৎসর্গ করা হবে। আর সে পালিয়ে যাবে।
বাবাজ্বী জানতেন না যে, রোজী অন্তঃপুরে তার অলঙ্কার বের করে দেখিয়েছে। আর বলেছে, যে তাকে তার পিতামাতার নিকট পৌঁছে দিবে তাকে এ অলঙ্কার দেয়া হবে।
এক ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে বাবাজ্বী বড় পাদ্রীর নিকট গেলেন। বড় পাদ্রী অন্যগ্রামে থাকেন। গ্রামটি বেশ দূরে। তারা ঘোড়া নিয়ে রওয়ানা হল। রাত্রের ক্লান্তি এখনো দূর হয়নি রোজীর শরীর থেকে। তাই গোসল করে নতুন কাপড় পরে খাবার গ্রহণ করা মাত্র তার চোখ জুড়ে নেমে এল রাজ্যের ঘুম।
***
সূর্য অস্তমিত হতে এখনো বেশ বাকি। বাবাজ্বী ফিরে এসে শুনতে পেল, রোজী এখনো বিছানায়। বাবাজ্বী তার স্ত্রীকে নির্জনে ডেকে নিয়ে বলল, বড় পাদ্রীর নির্দেশ আজ রাতেই তাকে সেই আগের স্থানে নিয়ে গিয়ে নীল নদে বিসর্জন দিতে হবে। এবার তার হাত বেঁধে বিসর্জন দিতে হবে। যেন সাঁতরে বেঁচে যেতে না পারে।
বাবাজ্বীর স্ত্রী বলল, মেয়েটির নিকট মূল্যবান বহু অলঙ্কার আছে। সে তা লুকিয়ে রেখেছিল।
বাবাজ্বী বললেন, এখনই মেয়েটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে দাও। অলঙ্কারগুলোও পরিয়ে দিবে। এখনই তাকে নিয়ে যেতে লোকেরা চলে আসবে। যাও,আর দেরি করো না।
স্ত্রী বলল, এক্ষুণি আমি তাকে তৈরী করে আনছি। আর কত ঘুমাবে। নীল নদের কোলেই সে চির শান্তির ঘুম ঘুমাবে।
একথা বলতে বলতে সে রোজীর কামরায় প্রবেশ করল। রোজী তখন সজাগ। সে কথাগুলো শুনে ফেলল।
বাবাজ্বীর স্ত্রী বৃদ্ধা। সে রোজীকে জাগ্রত করে সাজিয়ে দিতে লাগল। রোজী জিজ্ঞেস করল, তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে? উত্তরে বৃদ্ধা মহিলা এমন কিছু কথা অসতর্কভাবে বলে ফেলল যা দ্বারা রোজী বুঝে ফেলল যে, তাকে পুনরায় নীল নদে ফেলা হবে। সে বেঁকে বসল।
বাবাজ্বীকে সংবাদ দেয়া হল, রোজীকে অনেকভাবে বুঝানো হয়েছে, ফুসলানো হয়েছে। কিন্তু সে বেঁকে বসে আছে। এবার বাবাজ্বীর আশঙ্কা হতে লাগল, যদি সাম্রাজ্যের কোন অফিসার বা কর্মচারী এ সংবাদ জানতে পারে তাহলে তাদের সবাইকে গ্রেফতার করে কয়েদখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করবে।
বাবাজ্বী বয়োবৃদ্ধ। জীবনে অনেক জায়গায় ভ্রমণ করেছে। ষোল ঘাটের পানি খেয়েছে। তাই সে কপট স্নেহের জাল ফেলে শিকার করতে চাইল। স্নেহে গদগদ কণ্ঠে বলল, আহা, আহা, মেয়েটি আমার যদি অলঙ্কার পরতেই না চায় তাহলে তাকে কেন তোমরা বিরক্ত করছে, তার অলঙ্কার পরার প্রয়োজন নেই। ওর অলঙ্কার ওর কাছেই থাকুক।
রোজীর কণ্ঠ একটু তীক্ষ্ণ ও শ্লেষে ভরা। বলল, এ অলঙ্কার আমার নয়। এগুলো আমি আমার কাছে রাখতেও চাই না। যার অলঙ্কার তাকে তা পৌঁছে। দিন।
সূর্য তামাটে রং ছড়িয়ে পশ্চিমাকাশে অস্তমিত হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। রোজীকে বাইরে আনা হল। সারাদিনেই চারদিকে এ গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে, গতকাল এক মেয়েকে নীল নদে বিসর্জন দেয়া হয়েছিল। তাকে নীল গ্রহণ করেনি। উগলে দিয়েছে। আজ আবার তাকে বিসর্জন দেয়া হবে। নীলের বক্ষে তাকে ডুবে মরতেই হবে। অন্যথায় নীল ক্ষুব্ধ হয়ে, ধ্বংসলীলা শুরু করবে।
অনুসন্ধিৎসু জনতা সন্ধ্যার আগেই জমতে শুরু করেছে। একজন দুজন করে অনেক মানুষ সমবেত হয়েছে। এ গ্রামের সবাই মিসরী খ্রিস্টান। এরাই সাম্রাজ্যের বিধান উপেক্ষা করে ধর্মের নামে এ বিসর্জন প্রথা আঁকড়ে আছে। প্রত্যেক বৎসর গোপনে তারা এ কাজ করে। তারা রোজীকে অত্যন্ত পবিত্র ও বরকতময় মনে করে দেখতে এসেছে। তারা জানে না যে, দাগাবাজী করে, প্রতারণা করে রোজীকে নীল নদে বিসর্জন দেয়া হচ্ছে। রোজীকে বাইরে আনা হলে লোকেরা তার হাত ও জামায় চুমু খেতে থাকে।
একটু দূরে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা একটু উচ্চ কণ্ঠেই বলল, ঐ তো এসে গেছে। যাকে নীলের বুকে বিসর্জন দেয়া হবে সে এসে গেছে।
এ ধরনের আরো কিছু কথা রোজী নিজ কানেই শুনল। তার দৃঢ় বিশ্বাস হয়, তাকে ধোকা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যে দুব্যক্তির হাতে বাবাজ্বী রোজীকে তুলে দিতে চায় রোজী তাদের সাথে যেতে রাজি হল না। তারা রোজীর দুই বাহু ধরে জোর করে নিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু রোজী শক্ত হয়ে দাঁড়াল। কিছুটা টানা হেঁচড়া হল। মানুষের মাঝে শোরগোল শুরু হল। তারা হয়তো ভিন্ন কিছু চিন্তা করেছে।