অলঙ্কার না হয় লুকিয়ে রাখল কিন্তু নিজেকে, নিজের যৌবন আর রূপ শোভাকে কিভাবে লুকাবে! ভাবনার এক পর্যায়ে সে তার সকল অলঙ্কার খুলে ফেলল। যেন কোন ডাকাতের খপ্পরে না পরে। ভাবল, অলঙ্কারগুলো নদীতেই ফেলে দিবে। কিন্তু পরক্ষণেই বিদ্যুতের মত চমকে উঠল। ভাবল, না, এভাবে ফেলে দেয়া যায় না। বরং এগুলো দিয়ে কারো সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
অলঙ্কারগুলো কীভাবে লুকিয়ে রাখবে তা-ই ভাবছে। ঘাগড়ার মত এক প্রকার পোষাক তার গায়ে ছিল। সে জামার নিজের দিকের কিছু অংশ ছিঁড়ে তাতে অলঙ্কারগুলো বাঁধল। তারপর তা পুটলির মত বানিয়ে কাপড়ের নিচে বেঁধে নিল।
অর্ধরাত পেরিয়ে গেছে। সে অত্যন্ত ক্লান্ত। তার ভীষণ ঘুম পেয়েছে। নিকটে একটি বৃক্ষ। সে বৃক্ষের নিচে গিয়ে বসে পড়ল। তারপর ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল।
***
ঘুম ভেঙ্গে গেল। তবুও ঘুমের আবেশে চোখ দুটি তার লেগে আছে। মনে হচ্ছে, যেন তার চারপাশে কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। সে চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল। দেখল, তার চারপাশে বহু মানুষ জমায়েত হয়েছে। সবার চোখে রাজ্যের বিস্ময়।
এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? এখানে কেন পড়ে আছ?
রোজী বলল, সব বলব। তবে আমাকে আগে এমন এক বাড়িতে নিয়ে চল, যেখানে মহিলা আছে। আমি প্রবঞ্চিত হয়ে এখানে এসেছি। আমি নদী থেকে উঠে এসেছি।
রোজী বুঝল, এরা শ্রমিক ও নীচু শ্রেণীর মানুষ। পাপাচারী বা বদলোক নয়। যদি তেমন লোক হত তবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু তামাশা দেখত না এখনো।
এক ব্যক্তি বলল, আমাদের বাবাজ্বী আসছেন। তিনি বলবেন, তোমাকে কোথায় নিতে হবে। তোমার ধর্ম কি?
রোজী বলল, আমি খ্রিস্টান।
সে লোকটি বলল, তাহলে ভয়ের কিছুই নেই। আমরাও সবাই খ্রিস্টান। মিসরী খ্রিস্টান।
রোজীও তাদেরকে আশ্বস্ত করার জন্য বলল, আমিও মিসরী খ্রিস্টান।
একটু পরেই ঘোষণার মত একটু উঁচু কণ্ঠে একজন বলল, ভাইয়েরা! সরে দাঁড়াও। সরে দাঁড়াও। বাবাজ্বী আসছেন। সাথে সাথে সবাই পিছনে সরে এসে রাস্তা করে দিল। এক বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি রোজীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার চেহারা, পোষাক, আর পদবিক্ষেপে মনে হয়, তিনি একজন উঁচু মর্যাদার লোক। রোজীকে দেখেই সে ভূত দেখার মত ভয় পেয়ে দুকদম পিছিয়ে গেল। তারপর তার চেহারার রং এমন পরিবর্তিত হয়ে গেল যা লুকাবার নয়।
বাবাজ্বী বলল, আমি তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব। সেখানে আমার স্ত্রী আছে, দুমেয়ে আছে আর পুত্রবধূ আছে।
রোজী বলল, আমি এমন বাড়িতেই যেতে চাই যেখানে মহিলা আছে।
বাবাজ্বী তাকে সাথে করে নিয়ে গেল। রোজী চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখল। একদিকে নীল নদী। যার তীরে ছোট বড় নৌকা বাঁধা আছে। আরো একটু দূরে পালতোলা বেশ কিছু নৌকা নোঙর করে আছে। কিছু নৌকা থেকে লোকেরা নামছে। আবার কিছু নৌকায় লোকেরা আরোহণ করছে। রোজী বুঝল, এটা নৌঘাট। এখান থেকে নৌকায় চড়ে লোকেরা দূরে দূরে যায়।
নদী থেকে আধমাইল দূরে একটি লম্বা গ্রাম। সেখানে ছোট ছোট ঝোঁপড়ির মত বাড়ি দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু ইট পাথরের নির্মিত বাড়িও আছে। এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষই মৎসজীবী, জেলে বা মাঝি মাল্লা। এটা খ্রিস্টান পল্লী। ইতিমধ্যে গ্রাম থেকে নৌঘাটে মানুষের যাতায়াত শুরু হয়ে গেছে।
বাবাজ্বী গোত্রের সর্দার। মিসরী খ্রিস্টানদের নিকট সে এক উঁচু মর্যাদার ব্যক্তিত্ব। রোজীর সাথে কোন কথা না বলেই সে তাকে তার বাড়িতে নিয়ে এল এবং একটি কামরায় তাকে বসতে দিল। তারপর বাড়ির নারীদের ডেকে রোজীর নিকট থেকে সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত জানতে বললো। তারা জিজ্ঞাসা করল, তুমি কে? কেন তোমার এ অবস্থা হল, তা তুমি সুস্পষ্ট করে বল।
রোজী মহিলাদের নিকট তার জীবন কাহিনী বিস্তারিত বললো। শোনাল কি মনোভাব নিয়ে সে ইন্তাকিয়ায় পৌঁছেছে। তারপর মিসরে এ স্থানে কিভাবে পৌঁছেছে।
বাবাজ্বী নিরবে সবকিছু শুনল। রোজী তার জীবনের বেদনাতুর কাহিনী শেষ করল। বাবাজ্বী তার স্ত্রীকে বলল, মেয়েটিকে গোসল করাও। নতুন কাপড় পরিয়ে দাও এবং খাবারের আয়োজন কর। তারপর সে রোজীর কাঁধে হাত রেখে নরম কণ্ঠে বলল, এ বাড়িটিকে তুমি নিজের বাড়ি মনে করবে। তোমাকে তোমার ঠিকানায় পৌঁছে দেয়া হবে। তারপর বাবাজ্বী বাইরে চলে গেল। এবং এক ব্যক্তিকে দুতিনটি নাম বলে তাদের ডেকে আনার নির্দেশ দিল।
***
বাবাজ্বীর হাবেলী খুব শানদার ও প্রশান্ত। দেখলেই মনে হয় তিনি তার গোত্রের প্রধান সর্দার। রোজী অন্তঃপুরে চলে গেছে। বাবাজ্বী বাইরে বৈঠক খানায় বসে আছে। ইতিমধ্যে তিনি যাদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন তারা এসে গেছে। অত্যন্ত গুরু গম্ভীর ভাবে বাবাজ্বী তাদের দিকে তাকালেন। তাদের একজন বিস্মিত কণ্ঠে বলল, বাবাজ্বী! শুনলাম এক যুবতাঁকে একাকী পাওয়া গেছে?
বাবাজ্বী বলল, সে এখন আমার ঘরে। সে জন্যেই তো আমি তোমাদের ডেকে পাঠিয়েছি। তোমরা জান, গতরাতে নীল নদে এক যুবতাঁকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। সে যুবতীই এই। সে মরেনি। জীবিত অবস্থায় নদী থেকে উঠে এসেছে। নীল নদ আমাদের উৎসর্গকে কবুল করেনি। আমাদের উপঢৌকন গ্রহণ করেনি। উগলিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছে। নীল আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট। হয় তার প্রবাহ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে বা দুকূল ছাপিয়ে এমন বন্যা আসবে যা কেউ কখনো দেখিনি। ফলে আমাদের ফসলের জমি ভেসে যাবে। গ্রামগুলো তলিয়ে যাবে। চারদিকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে।