আজ থেকে দশ বার বৎসর পূর্বে নীল নদে কুমারী উৎসর্গ করার সময় চারদিকে ঘোষণা করা হত। দলে দলে লোক সমবেত হত। যে যুবতাঁকে উৎসর্গ করা হবে তারা তাকে অত্যন্ত পবিত্র মনে করত। লাইন ধরে তার হাতে চুমু খেত। কিন্তু সম্রাট হিরাক্লিয়াস এ ধরনের উৎসর্গকে দণ্ডনীয় অপরাধ ঘোষণা করেছে। তার আইনে এটা হত্যাকাণ্ড। যাকে এ ধরনের কাজের সাথে জড়িত পাওয়া যাবে তাকেই মানব হত্যার শাস্তি ভোগ করতে হবে। সম্রাটের এ নির্দেশের পর প্রকাশ্যে আর কাউকে উৎসর্গ করা হয় না। তবে গোপনে রাতের অন্ধকারে তারা এ প্রথা পালন করে থাকে।
রাতের অন্ধকারে তারা রোজীকে জনবসতি থেকে দূরে নীল নদের তীরে নিয়ে গেল। হোরশীছ তাকে বলেছে, নদীতে একটি নৌকা রাখা আছে। সে নৌকা দিয়ে তাকে ইস্কান্দারিয়া নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানেই হিরাক্লিয়াসকে হত্যা করা হবে। সেখানে প্রধান পাদ্রী ছিল। কবীলার গণ্যমান্য কিছু লোকও ছিল।
পাদ্রী তার শরীরে সুগন্ধি পানি ছিটিয়ে দিল। বিড়বিড় করে কি কি সব মন্ত্র পাঠ করল। তারপর তার দুই কাঁধের উপর হাত রাখল। বিড়বিড় করে আরো কি যেন পাঠ করল। বাহু ধরে তাকে নদীর তীরে নিয়ে গেল। সেখানে তীর বেশ উঁচু ছিল। পাদ্রী পিছন দিক দিয়ে ধাক্কা মেরে রোজীকে নীল নদীর পানিতে ফেলে দিল। রোজী কোন কিছু বুঝার আগেই ঝুপ করে পানিতে পড়ে গেল।
চারদিক অন্ধকার। গাঢ় অন্ধকার। পাদ্রী আর উপস্থিত লোকেরা সুর দিয়ে একটি ধর্মীয় আমেজের কবিতা আবৃতি করতে করতে চলে এল। যদিও নদী অত্যন্ত গভীর কিন্তু সেদিন স্রোত তেমন প্রবল ছিল না। নদী ছিল অনেকটা শান্ত।
রোজী কবিলার সর্দারের মেয়ে। দারুণ চঞ্চল আর চটপটে। তাদের পল্লীর পাশ দিয়েই বয়ে গেছে প্রবাহমান ফুরাত নদী। রোজী তার দুতিনজন সখীকে নিয়ে প্রায়ই নদীতে নাইতে যেত। জলকেলী করত। পানি ছুড়াছুড়ি করত। সাঁতার কাটত। বয়স একটু বাড়লে রোজীর দৌরাত্মও বেড়ে গেল। সাঁতার কেটে কেটে সে মাঝ নদীতে চলে যায়। স্রোতের উল্টো দিকে সাঁতার কেটে চলতে থাকে। উঁচু তীর থেকে ঝাঁপিয়ে নদীতে পড়ে। তার এই সাঁতার দক্ষতার কারণে সখীরা তাকে হাসী বলে ডাকত।
রোজীকে নীল নদীতে নিক্ষেপ করা হলে পানিতে পড়েই তার প্রথম আত্মরক্ষার চিন্তা এল। যে করেই হোক তাকে জীবনে বাঁচতে হবে। পানিতে পড়েই সে ভেসে উঠল না। পানির নীচ দিয়ে সাঁতার কেটে কেটে সে খানিক দূর চলে গেল। দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলেই সে পানির উপর ভেসে উঠল এবং নদীর অন্য পারের দিকে সাঁতার কাটতে লাগল। অন্ধকারে কেউ তাকে দেখতে পেল না। তাছাড়া তাকে নদীতে ফেলে দিয়েই সবাই সুর দিয়ে কবিতা পাঠ করতে করতে চলে এসেছে।
রোজী এক রকম ভাসতে ভাসতে নদীর অপর পারে চলে এল। অন্ধকারে সে নদীর তীরে বসে হাঁপাতে লাগল। চারদিকে সে উদ্বিগ্ন ও ভীত দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। তার মনে হচ্ছে যেন সে স্বপ্নের জগত থেকে হঠাৎ জাগ্রত হয়েছে। ইতিমধ্যে তার চিন্তাশক্তি ফিরে এসেছে। সে ভেবেই পাচ্ছে না, তার শরীরে এতো মূল্যবান অলঙ্কার এলো কোত্থেকে!
সেখানে বসেই সে চিন্তা করতে লাগল, এখন তার কি হবে? সে তার বাড়ি থেকে কোথায় চলে এসেছে তা ঠিক করতে পারছে না। তবে কি এটা ফুরাত নদী। কিন্তু এমন স্থান তো সে কোথাও কখনো দেখেনি।
তার চিন্তাশক্তি আরো স্বচ্ছ, আরো পরিচ্ছন্ন হয়ে আসতে লাগল। ধীরে ধীরে তার যুদ্ধের কথা স্মরণ হল। রক্তাক্ত সে যুদ্ধ। তারপরই হঠাৎ তার মানস পটে ইউকেলিসের চেহারা ভেসে উঠল। রক্তাক্ত মুমূর্ষ ইউকেলিস। সাথে সাথে তার শরীরে কম্পন সৃষ্টি হল। তার মনে হল, শতে শতে লাশের মাঝে সে ইউকেলিসকে খুঁজছিল। তার আরো মনে এল, ইউকেলিসের লাশের পর সে ইউকেলিসের মায়ের লাশও দেখেছিল। তার মনে হল, এরপরই সে এক স্বপ্নের জগতে হারিয়ে গিয়েছিল।
প্রচণ্ড মানসিক আঘাতের কারণেই রোজীর স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তবে একেবারে উন্মাদ হয়ে যায়নি। অন্ধকারের মাঝে বসে সে উন্মুক্ত নির্মল আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। ধীরে ধীরে তার স্মৃতি শক্তি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে আসতে লাগল। হিরাক্লিয়াসের কথা স্মরণ হল। সে যে হিরাক্লিয়াসকে হত্যা করার জন্য বেরিয়ে ছিল তাও মনে পড়ল। মানুষ তাকে ডাইনী বা প্রেতাত্মা মনে করে ভয় করত। সে কারো সামনে এলেই সে ভয় পেত। সে মানুষের খাবার ও পানীয় নিয়ে নিত। এভাবেই সে বেশ কিছুদিন মরুভূমি আর ঝোঁপঝাড়ের মাঝে কাটিয়েছিল।
তারপর তার ঐ ব্যক্তির কথাও মনে এল, যে তাকে জাহাজে করে মিসর নিয়ে এসেছে। মনে এল তাকে দুমহিলা নতুন কাপড় পরিয়ে অলঙ্কার দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে। বলা হয়েছে যে, হিরাক্লিয়াসকে হত্যা করার জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইউকেলিসের খুনের প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছে এই ভেবে সে আনন্দিত ও বিমুগ্ধ ছিল। ধীরে ধীরে তার নিকট সবকিছুই তার মানসপটে ভেসে উঠল। সবকিছুই যেন সে বুঝতে পারল। কিন্তু তাকে কেন নদীতে ফেলে দেয়া হল এর কোন কারণ সে খুঁজে পেল না।
***
নিরব নিস্তব্ধ এই অন্ধকার রজনীতে ইউকেলিসের কথা স্মরণ হতেই অঝোর ধারায় তার চোখ দিয়ে অশ্রু নেমে এল। কিন্তু এখন তার প্রেমিক হারানোর বেদনা এমন তীব্র নয় যে, চিন্তাশক্তি বিকল হয়ে যাবে। সে এখন নিজেকে নিয়েই দারুণ চিন্তায় পড়ে গেল। একতো তার সাথে রয়েছে মূল্যবান অলঙ্কার। তার চেয়ে আরো বেশী মূল্যবান তার কুমারিত্ব।