ইন্তাকিয়ার শাসক যখন জিজ্ঞেস করল, এ মেয়েটিকে কে তার বাড়িতে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে প্রস্তুত? তখন, হোরশীছের মাথায় এক নব চিন্তার স্ফুরণ ঘটল। সে ফিস্ ফিস্ করে তার সাথীদের সাথে পরামর্শ করল। সাথীরা তার মতে সায় দিল। বলল, মেয়েটিকে নিয়ে নাও। এটি দিয়ে এবার কাজ সেরে দিব। তারা মেয়েটিকে সাথে নিয়ে নিল।
সমুদ্রের বুক চিরে জাহাজটি মিসরের দিকে ছুটে চলছে। সাঁ সাঁ রব তুলে ঢেউয়ের পর ঢেউ আসছে আবার দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। শীতল বাতাসে প্রচুর জলজ গন্ধ। দিনের বেলা গাং চিলগুলো জাহাজের পাশে পাশে উড়ে। বেশ কিছুক্ষণ উড়ার পর আবার হারিয়ে যায়।
ফেরার পথে একদিন রাতে হোরশীছ ও তার সাথীরা রোজীকে জাহাজের ছাদে নিয়ে গেল। তার মনকে আকৃষ্ট করার জন্য সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে তারা কথাবার্তা শুরু করল। রোজীও তাদের সাথে খোলামেলা কথাবার্তা বলছে। সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে হত্যার বিভিন্ন কৌশল নিয়েও তারা আলোচনা করল। তাদের আলোচনায় রোজী অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত হল। উল্লাসে তার চেহারা চিক চিক করে উঠল।
কথার এক ফাঁকে হোরশীছ রোজীকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা রোজী, তুমি কি কুমারী?
উত্তরে রোজী বলল, হ্যাঁ। তারপরই তার কণ্ঠ একটু কঠিন শোনা গেল। বলল, মাতা মেরী যিনি হযরত ঈসা (আ)-কে জন্ম দিয়েছিলেন আমি তারই মত কুমারী। কিন্তু….. কিন্তু এ কথা কেন আমাকে জিজ্ঞেস করছো?
হোরশীছ মোলায়েম কণ্ঠে বলল, না, না। আমরা কোন সন্দেহ করছি না। তবে পূর্বপুরুষদের কাছে শুনেছিলাম যদি নিপীড়িত কুমারী নারী কোন জালিমকে হত্যা করে, তাহলে তার কোন পাপ হয় না। হিরাক্লিয়াসের চেয়ে জালিম শাসক এ দুনিয়ায় আর কে আছে?
দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার পর একদিন জাহাজ মিসরের ইস্কান্দারিয়া বন্দরে এসে থামল। সে কী বিরাট বন্দর। জাহাজের পর জাহাজ বন্দরে নোঙর করে আছে। একের পর এক যাচ্ছে আবার একের পর এক আসছে। সর্বত্র হাট বাজারের মত মানুষের ভিড়। স্রোতের ন্যায় মানুষের যাত্রা প্রবাহ লেগেই আছে। মুসাফিররা একের পর এক নেমে যার যার গন্তব্যে চলে গেল। ইস্কান্দারিয়া থেকে দূরেই হোরশীছের বাড়ি। তারা একটি উট ভাড়া করে নিয়ে সন্ধ্যার পর বাড়িতে পৌঁছল।
পরদিন সকালে হোরশীছ তার সাথী দুজনকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে গেল। সে গ্রামে তাদের অঞ্চলের সবচেয়ে বড় পাদ্রীর গীর্জা। গীর্জার পাশেই তার আলীশান কামরা। সে কামরায় তিনি সব সময় থাকেন। তারা গিয়ে সোজা পাদ্রীর কামরায় পৌঁছল। লোকটি সাদা ধবধবে শশ্রুমণ্ডিত সুঠাম দেহের অধিকারী। চোখ দুটি ছোট ছোট, পিট পিটে। ধুরন্ধরীর গন্ধ আসে তার চোখ থেকে। পাদ্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে কুশলাদি বিনিময় করল। ইন্তাকিয়া থেকে আনা কিছু উপঢৌকন তার পদপ্রান্তে রাখল। তারপর হোরশীছ তার কণ্ঠে অত্যন্ত দৃঢ়তা ও আত্মনির্ভরশীলতা এনে বলল, বাবাজ্বী মহাশয়! আমরা যখন ইন্তাকিয়ায় ঠিক তখন আমাদের সাথে এক মিসরী খ্রিস্টান ব্যবসায়ীর সাক্ষাৎ। আমাদের পেয়ে সে দারুণ আপ্যায়ন করল। তারপর যীশুর কসম দিয়ে বলল,আমি ব্যবসায় মার খেয়েছি। এখন প্রায় নিঃস্ব অবস্থা। অন্ন সংস্থান করাই দায় হয়ে পড়েছে। দুশ্চিন্তায় আকাশ ভেঙে পড়েছে আমার মাথায়। দিশেহারা হয়ে ছুটে গেলাম গির্জায়। চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষণ জপতপ করলাম। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে গেছি স্মরণে নেই। হঠাৎ দেখলাম, যীশু আমার সামনে উপস্থিত। চারদিক আলোতে উদ্ভাসিত। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছেন। আমি ভড়কে গেলাম। তিনি আরো খানিকটা এগিয়ে এসে বললেন, শোন, হে মিশরী! তোমার ঐ কুমারী কন্যাকে নীল নদীতে উৎসর্গ কর। তোমার ব্যবসায় উন্নতি হবে। নীলের অববাহিকায় বসবাসরত লোকদের আশীর্বাদ পবে। আবার তোমার সুদিন ফিরে আসবে।
হোরশীছের সাথী দুজন তাকে সমর্থন করল। বলল, লোকটি তার কুমারী কন্যাকে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে। বলেছে, এ বৎসরই যেন তাকে নীল নদে উৎসর্গ করা হয়।
হোরশীছের কণ্ঠ একটু দৃঢ় শোনা গেল। বলল, এ বৎসরই তাকে নীলে উৎসর্গ করতে হবে। সে একটি আমানত। কিছুতেই আমরা তার খেয়ানত করতে পারি না।
পাদ্রী দুচারটি কথা জিজ্ঞেস করার পর বলল, মেয়েটিকে আমার সামনে নিয়ে এসো।
পরদিন সকালে তারা রোজীকে পাদ্রীর নিকট নিয়ে এল। পাদ্রী আপাদমস্তক রোজীকে দেখল। তারপর জিজ্ঞেস করল। তুমি কি স্বেচ্ছায় এসেছো, না তোমাকে জোর করে আনা হয়েছে।
রোজী পাদ্রীর কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝল না। বলল, আমি ইচ্ছে করেই এসেছি। রোজী তখনো অসুস্থ। চিন্তাশক্তি তার বিকল। ভালমন্দ কিছুই সে অনুধাবন করতে পারছে না। তবে পাদ্রীর সামনে বসে সে হাসল। বুদ্ধিমানের মত দুচারটি কথা বলল। পাদ্রীর সকল সন্দেহ দূর হয়ে গেল। সে তাকে নীল নদে উৎসর্গ করার নির্দেশ দিয়ে দিল।
***
হোরশীছ ও তার স্ত্রী রোজীকে সীমাহীন আদর যত্ন করতে লাগল। তার কথার তালে তারা কথা বলে। তাকে সান্ত্বনা দেয়। প্রবোধ দেয় এবং বলে, শীঘ্রই হিরাক্লিয়াসকে হত্যার পরিকল্পনা করা হবে। তোমাকেই তাকে হত্যার দায়িত্ব দেয়া হবে। রোজীকে নীল নদে উৎসর্গের দিন এসে গেল। সন্ধ্যায় তাকে গীর্জায় নেয়া হল। আজ তাকে হোরশীছের স্ত্রী অপরূপ সাজে সজ্জিত করে দিয়েছে। মূল্যবান ঝলমলে কাপড় তার গায়ে। হোরশীছের মেয়ে সকল অলঙ্কার তাকে পরিয়ে দিয়েছে। যেন সে এক সাক্ষাৎ স্বর্গের অপ্সরী।