সালারের কথা শুনে যুবতীর অবয়বে দ্বিতীয়ার চাঁদের ন্যায় ক্ষীণ সরু এক হাস্যরেখা ফুটে উঠল। খ্রিস্টান লোকটি তার সাথে মমতাভরা ভাষায় কথা বলল। যুবতী তাদের সাথে যেতে প্রস্তুত হয়ে গেল।
সালার বললেন, আজ রাতে সে আমার বাড়িতে মহিলাদের সাথে থাকবে। আগামীকাল ফজরের নামাযের পরই তাকে খ্রিস্টান লোকটির নিকট অর্পণ করা হবে। তারপর সে তাকে নিয়ে মিসর চলে যাবে।
***
ফজরের নামাযের পর সালার মসজিদে বসে কুরআন তিলাওয়াত করেন। ইশরাকের নামায শেষে বাড়িতে পৌঁছে দেখেন, খ্রিস্টান সেই তিন লোক তার অপেক্ষায় দহলিজে বসে আছে। সালার মেয়েটিকে তাদের নিকট সমর্পণ করে দিলেন। তারা তাকে নিয়ে চলে গেল। ইন্তাকিয়া থেকে ইস্কান্দারিয়া যাওয়ার পথ দুটি। স্থল পথ ও সমুদ্র পথ। তারপর দিনই ইস্কান্দারিয়ার উদ্দেশ্যে একটি জাহাজ ইন্তাকিয়া ছেড়ে চলে গেল। সে জাহাজেই তারা রোজীকে নিয়ে মিসরের উদ্দেশে রওয়ানা দিল।
রোজীর কথার মাঝে একটি প্রতিজ্ঞাই বার বার ফুটে উঠছে। সে হিরাক্লিয়াসকে হত্যা করে তার খুন পান করবে। খ্রিস্টানরা তাকে এ ব্যাপারে উৎসাহ দিল। তার মন মতই তার সাথে আচরণ করতে লাগল।
রোম সাগরের বুক চিরে জাহাজটি ছুটে চলছে। চারদিকে পানি আর পানি। পানির জগত। মাঝে মাঝে পাল তোলা জাহাজের সমাগম। সকালে মনে হয় পানির বুক থেকে আগুন ছড়িয়ে সূর্য আকাশে উঠে আসছে। আর সন্ধ্যায় মনে হয়, ক্লান্ত সূর্য বিষণ্ণ মুখে আবার পানির বুকেই আত্মবিসর্জন দিচ্ছে। দিগন্তের দিকে দৃষ্টি ফেললে মনে হয়, আকাশ আর পানির অপূর্ব মাখামাখি। দৃষ্টিনন্দন মিলন।
রাতে রোজী ঘুমিয়ে পড়লে খ্রিস্টান তিনজন জাহাজের ছাদে চলে যায়। গল্পগুজব করে। তারপর ঘুমায়। একদিন তাদের একজন অপরজনকে বলছে, বন্ধু হোরশীছ! আমার তো বিশ্বাস, তোমার মেয়ে এ যাত্রায় বেঁচে যাবে। মনে হয় এ মেয়েটি কুমারী।
হোরসীছ বলল, আমারও তাই মনে হয়। আমি তো নিজেকে নিরূপায় ভেবে এ মর্মান্তিক আঘাতের জন্য প্রস্তুত করে নিয়েছিলাম। মানসিক প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম যে মেয়েটিকে নীল নদে বিসর্জন দিব। খোদার খাস মেহেরবানীতে এ যুবতাঁকে পেয়ে গেলাম। যদি ধর্মীয় গুরু এ মেয়েকে কবুল করে নেন তাহলে কঠিন কষ্ট থেকে বেঁচে যাব।
অন্য সাথী বলল, তুমি বেঁচে যাবে। নিশ্চয় তুমি আল্লাহর সাহায্য পেয়েছে। তুমি বড়ই ভাগ্যবান।
রোজীকে পেয়ে হোরশীছের এক বিরাট বিপদ কেটে গেছে। এ ছিল তার এক অসহনীয় মসীবত। মুসলমানদের সালার ইন্তাকিয়ার আমীর একটুও সন্দেহ করতে পারেনি যে, এ খ্রিস্টানরা মানবতার নামে, হামদর্দীর নামে তাকে ধোঁকা দিয়ে রোজীকে নিয়ে গেল।
মিসরের খ্রিস্টানদের প্রথা ছিল, তারা প্রত্যেক বৎসর এক নির্দিষ্ট রাতে নীল নদীতে একজন কুমারী যুবতাঁকে অপরূপ সজ্জায় সজ্জিত করে নদী বক্ষে বিসর্জন দিত। পিতামাতার সন্তুষ্টচিত্তেই ধর্মীয়গুরু তা পালন করত। কখনো কোন মেয়েকে জোর জবরদস্তি করে নদী বক্ষে নিক্ষেপ করা হত না।
পর্যায়ক্রমে প্রত্যেক কবিলা থেকে একজন কুমারী যুবতাঁকে বিসর্জন দেয়া হত।
এ বৎসর যে কবিলার জিম্মায় বিসর্জনের পালা পড়েছে সে কবিলায় শুধুমাত্র হোরশীছেরই একমাত্র যুবতী কুমারী মেয়ে আছে। আর কারো নেই। হয় বিয়ে হয়ে গেছে, নয়তো অল্প বয়সী। ধর্মীয়গুরু হোরশীছকে ডেকে জানিয়ে দিয়েছে, এ বৎসর তার মেয়েকে বিসর্জন দিতে হবে। হোরশীছের একমাত্র সন্তান তার এ মেয়ে। মেয়েটিকে সে হৃদয়ভরা মমতা দিয়ে বড় করে তুলেছে। এ কথা সত্য, তার অনুমতি ও সন্তুষ্টি ছাড়া মহাপাদ্রী তার মেয়েকে বিসর্জন দিতে পারবে না। তবে হোরশীছের পক্ষে মহাপাদ্রীর নির্দেশ অমান্য করাও সম্ভব নয়। এ সংবাদ শোনার পর হোরশীছের স্ত্রীর মাতম শুরু হয়ে গেছে। খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ। দিনরাত শুধু কান্না আর কান্না। এই সুখী পরিবারটিতে নরকের অশান্তি নেমে এল। এদিকে হোরশীরের মেয়েও আত্মবিসর্জনে নারাজ। পরিশেষে হোরশীছ সিদ্ধান্ত করল, সে গীর্জায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করবে, তার মেয়ের শাদী না হলেও সে কুমারী নয়। সে মহাপাপী। তাই তাকে নীল নদে বিসর্জন দিয়ে নীল নদের পবিত্রতা সে নষ্ট করতে পারে না।
হোরশীছ ও তার স্ত্রী-মেয়ে কঠোর ভাষায় বলে দিয়েছে, সাবধান! আমরা যা বলি তাতেই তুমি অবিচল থাকবে। এতে আমাদের পরিবারের কবিলার ইজ্জত হানী হলে তোক তাতে কোন পরোয়া নেই।
মিসরের খ্রিস্টানদের এ বিশ্বাস ছিল অমূলক। নীল নদের পানি প্রবাহের সাথে যুবতী বিসর্জনের কোন সম্পর্ক ছিল না। সম্রাট হিরাক্লিয়াস যে রাষ্ট্রীয় খ্রিস্ট ধর্মের প্রচলন করেছিল তাতে এ ধরনের যুবতী বিসর্জন ছিল মারাত্মক অপরাধ। এ অপরাধ মানব হত্যার মতই গুরুতর। তাই মিসরের খ্রিস্টানরা তাদের প্রথা দিনে পালন না করে রাতের অন্ধকারে চুপি চুপি করত।
এখনো বিসর্জনের দুতিন মাস বাকি। হোরশীছ ব্যবসার উদ্দেশ্যে দুজন সাথীর সাথে ইন্তাকিয়ায় গিয়েছিল। ইন্তাকিয়ায় সব কাজকর্ম শেষ করে ফেরার পথে শুনতে পেল, নগরের আমীর এক বদরূহকে গ্রেফতার করে এনেছে। তাই সে তাকে দেখতে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল।
***
হোরশীছ ব্যবসায়িক কাজ শেষ করে মিসরে ফিরে যাওয়ার জন্য জাহাজের অপেক্ষা করছে। অকস্মাৎ শুনতে পেল, ইন্তাকিয়ার শাসক এক বদরূহ প্রেতাত্মা বা ডাইনীকে গ্রেফতার করেছে। হোরশীছ তার অনুসন্ধিৎসু মনকে দমন করতে পারেনি। সাথীদের নিয়ে ইন্তাকিয়ার শাসকের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য এসেছে।